৭ মে, ২০২৪
রবীন্দ্রনাথ থেকে বর্তমান : গ্রাম বাংলার জীবন যাপন
রবীন্দ্রনাথ থেকে বর্তমান : গ্রাম বাংলার জীবন যাপন
একটা গোটা সমাজের জীবন যাপনের মান নির্ভর করে, সেই সময়ের শিক্ষা ব্যবস্থা, সামাজিক অবস্থান, জ্ঞান চর্চা ও শিল্প চর্চা ইত্যাদির উপরে । জ্ঞানচর্চা বা শিল্পচর্চায় বাঙালি শুধু মাত্র আমাদের দেশে নয় সারা বিশ্বে সম্মানিত হয়ে এসেছে । কিন্তু সেই উন্নত জীবনের অনুশীলন চলেছে শুধুমাত্র শহর কেন্দ্রিক আরও নির্দিষ্ট করে বলা যায় কোলকাতা কেন্দ্রীক। বাংলার গ্রামগুলো আজীবন যেন কমল পাথরের দীপ্তি থেকে  দূরেই থেকে গেছে সেই অতীত থেকে আজকের বর্তমানেও ।
সময় বদলাচ্ছে আমরা আধুনিক থেকে অত্যাধুনিক হয়ে উঠছি,  আচারে পোষাকে নিজেদের বদলে ফেলেছি কিন্তু সেই অর্থে বাংলার গ্রাম জীবন কি বদলেছে ? প্রশ্ন একশ বছর আগেও যেমন বৈধ ছিল আজও তেমনিই গুরুত্বপূর্ণ।
 
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর পল্লীপ্রকৃতি , সমবায় প্রথা  ইত্যাদি গ্রন্থের প্রবন্ধ গুলিতে এবং তাঁর গল্পগুচ্ছের বহু গল্পে গ্রাম্য সমাজ সম্পর্কে বহু তথ্য  তুলে ধরেছেন, কখনও গল্পের মাধ্যমে কখন বিশ্লেষণধর্মী আলোচনার মাধ্যমে। তাঁর সেই পল্লীপ্রকৃতি এখন আর নেই। নেই তখনকার কলকাতাও। তখনকার পল্লীসমাজের অশিক্ষা, কুসংস্কার, স্বাস্থ্যজ্ঞানহীনতা প্রভৃতি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত বিচলিত ছিলেন, তাঁর জমিদারী অঞ্চলে বিষয়গুলি দূরীকরণের প্রবল চেষ্টাও করেছিলেন। রবীন্দ্র ভাবনায় পল্লীজীবনের অবনমনের কারণ হিসাবে দেখা দিয়েছে শহর ও গ্রামের মধ্যে দূরত্ব, গ্রামে শিক্ষা-সংস্কৃতি-জ্ঞান চর্চার অভাব, সম্পন্ন মানুষদের গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী হয়ে গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা ইত্যাদিকে।  কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সময় পেরিয়ে গেছে অনেক কাল আগে। এখন শহর গ্রামের মধ্যে মোটা দাগের পার্থক্য ঘুচে গেছে। গ্রামের হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন শহরে যায় কর্ম উপলক্ষে আবার শহরের হাজার হাজার মানুষ গ্রাম বাংলার প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে কর্ম উপলক্ষেই। তার উপরে এখন আছে প্রতি ঘরে ঘরে দূরদর্শন, প্রতি হাতে হাতে মুঠোফোন আবার শুধুমাত্র মুঠোফোন নয়,  স্মার্টফোন ফলে নিকটবর্তী শহর বা কোলকাতা শুধু নয় সারা বিশ্ব এখন আমাদের দুচোখের সামনে। ভাষার বাধা অনায়াসেই ঘুচে যাচ্ছে অনুবাদে। অতএব চাইলেই আমি পাব সারা বিশ্বকে আমার নিত্যদিনের জীবন যাপনে। 
 
জীবন উন্নত হয় জ্ঞানের আলোয় , মানুষে মানুষে ভাবনার আদান প্রদানের মিলনে, দেশ কালের গণ্ডি ঘুঁচিয়ে বিশ্বের সঙ্গে আলাপে। যে সুযোগ পূর্বে হাতে গোনা কয়েকটা উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মানুষ পেত যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিবারের সূত্রে পেয়েছেন, কতিপয় মানুষ পেয়েছেন শুধুমাত্র বই, পত্রিকা সংবাদপত্র ইত্যাদির মাধ্যমে তাও আবার শহরকেন্দ্রিকতায় , কিন্তু এখন সে সুযোগ আজ গ্রাম শহর নির্বিশেষে আমাদের দুহাতের তালুতে। এখন আমরা চাইলেই ন্যুনতম  জ্ঞান, শিক্ষা স্বেচ্ছায় অর্জন করতে পারি, দক্ষ হয়ে উঠতে পারি বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি বা শিল্পকলায়। নিজেকে উপহার দিতে পারি একটা শিক্ষিত-শৈল্পিক-জ্ঞানী-দক্ষ মানুষ। এটা একদম ঠিক এইভাবে কোনো বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন বা জ্ঞানের সেই গভীরতা সম্ভব নয় কিন্তু কিছুটা তো আমরা অর্জন করতে পারি। (এখানে আমি তথা কথিত বিদ্যালয় ভিত্তিক শিক্ষার কথা বলছি না, কারণ বিদ্যালয় ভিত্তিক শিক্ষায় অনেক আগে থেকেই পল্লী বাংলার অধিকাংশ মানুষ শিক্ষিত, আমি বলছি  মূল্যবোধের শিক্ষা, মনুষত্বের শিক্ষা, মুক্ত চিন্তার শিক্ষা, শুভ চেতনার শিক্ষা আর এই সমস্ত শিক্ষা দানে বিদ্যালয় ভিত্তিক শিক্ষা যে ব্যর্থ হচ্ছে তা আমাদের অজানা নয়)  এখন আপনারা বলতেই পারেন আমি তো প্রযুক্তিগত দক্ষতার কথাও বললাম, গ্রামের বিদ্যালয়গুলিতে প্রযুক্তিগত শিক্ষা দানের কোনো ব্যবস্থাই নেই তাই সেটাও যুক্ত করলাম। 
 
যাইহোক এখন আলোচনার বিষয় বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা যেটুকু সুযোগ পাচ্ছি সেটাকে কীভাবে কাজে লাগাতে পেরেছি বা কীভাবে কাজে লাগাচ্ছি। অর্থাৎ আমি গ্রাম বাংলার মানুষের কথা বলছি কারণ শহর অঞ্চলে সবকিছুর জন্য একাধিক পথ খোলা রয়েছে। কিন্তু গ্রাম শহরের দূরত্ব ঘুচলেও এখনও পর্যন্ত জ্ঞানচর্চা, শিল্পচর্চা, প্রযুক্তিগত ভাবে দক্ষ হয়ে ওঠার সুযোগ গ্রামের মানুষের হাতের কাছে আজও তেমনভাবে নেই তাই আমরা দু হাতে বন্দি বিশ্বে চোখ রাখতে পারি এবং রাখছিও ।
 
সমস্ত ধরণের খাবার আমাদের শরীরের পক্ষে যেমন ভালো নয়,  তাই আমরা শরীর স্বাস্থ্য বুঝে খাই, সেই রকম আমাদের মনের স্বাস্থ্য এবং জীবনের পক্ষে স্বাস্থ্যকর সেই সমস্ত বিষয় আমাদের গ্রহণ করা উচিত কিন্তু আমরা করি কি? আমরা আগে খুব সহজে পরিস্থিতিকে দায়ী করতে পারতাম এবং সেটা অনেকাংশ ক্ষেত্রেই ঠিক, বলে দিতেই পারতাম নিজের জীবনকে চেতনাকে সুন্দর ভাবে গড়ার কোনো কোনো অস্ত্রই যে আমার হাতে নেই, তাও ঠিক।  কিন্তু আজ, বিজ্ঞান যে সুযোগ তুলে দিল আমাদের হাতে হাতে তার সঙ্গে আমরা কী করলাম? যে হাতিয়ারকে কাজে লাগিয়ে আমাদের জ্ঞানের সীমা ব্যাপ্ত করার কথা , ব্যর্থ করার কথা আমাদের অশিক্ষা ও সুযোগের সংকীর্ণতাকে। ঘুচিয়ে ফেলার কথা কুসংস্কারাচ্ছন্ন অঞ্চলের গভীরতম অন্ধকার, মুক্ত করার কথা আমাদের ভাবনার বান্ধ্যত্ব। হতে পারার কথা বিশ্বসংস্কৃতির অংশীদার। কিন্তু হতে পারলাম কই, হতে পারছি কই, চেষ্টাই তো করিনি।
আমরা যে প্রযুক্তিকে দাস বানাতে পারতাম, নির্বোধের মতো সেই প্রযুক্তির দাস হয়ে বসে আছি। বিনোদনের অজুহাতে যত রকমের অপসংস্কৃতি ও  কুশিক্ষা প্রতি মুহূর্তে গ্রহণ করে নিজেদের মন ও জীবনকে আবর্জনার স্তূপে পরিনত করছি। অপচয় করছি মূল্যবান জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত , নির্বোধের মতো হত্যা করছি প্রতি ক্ষণ। ফলে আমাদের অর্থাৎ গ্রামের মানুষদের জীবন যাপনের গুণগত মান দিন দিন তলানিতে গিয়ে ঠেকছে। 
 
যদি গভীরে গিয়ে ভাবতে বসি তাহলে দেখা যায় উনবিংশ শতাব্দীর পল্লীবাংলায় মানুষ ছিল সংস্কার আচ্ছন্ন, অশিক্ষিত, স্বাস্থ্য নিয়ে অসচেতন।  কারণ সেই অর্থে তাদের কাছে শিক্ষা ছিল না, জ্ঞানের আশ্রয় ছিল না , জীবন চর্চার উপায় ছিল না। কিন্তু আজ , আজ তো আমাদের কাছে কিছু উপায় অন্তত আছে, সেই উপায় গুলোকে কাজে না লাগিয়ে কেন সস্তার বিনোদন ও অপসংস্কৃতির হাতে বলি দিচ্ছি আমাদের মূল্যবান জীবনকে, এর উত্তরও হয়তো সহজ। শিক্ষা, জ্ঞান, শিল্প চর্চার রাস্তাটা সহজ নয় , অনেকটা পথ সংঘর্ষে পেরোতে হয়, কঠোর পরিশ্রমেই জ্বলে জ্ঞানের আলো, শিল্পীত  জ্ঞানী জীবনকে হতে হয় সাহসী , কর্মঠ , পরিশ্রমী। মনের পরিশ্রমে তো পল্লী বাংলার মানুষ কোনো কালেই সেরকম অভ্যস্ত ছিল না , আর শরীরের পরিশ্রম দিন দিন ভুলতে বসেছে । তাই এখন তারা ভীষণ অলস। (কেন তাদের এই শারীরিক পরিশ্রমে অরুচি ঘটল সে আলোচনা অন্য কোথাও করা যাবে)। শরীরে মনে তাদের এই তীব্র আলস্যে, ভেঙে পড়ছে কয়েক কোটি মানুষের জীবনের গুণগত মান। দ্রুত এই সমস্যার সমাধান না করলে সামনে সমূহ বিপদ , তীব্র গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে প্রযুক্তিগত অপসংস্কৃতির সংক্রমণ। এখুনি এই সমস্যার সমাধান না করলে ভারতের সিংহ ভাগ বাঙালিকে অপসংস্কৃতির পাঁকে ডুবে যেতে দেখব। পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের কথা এখানে বললেও  আমরা জানি গ্রাম শহর নির্বিশেষে সারা দেশের মানুষ খুব দ্রুত শরীরে মনে অলস শুধু নয়,  ক্ষতিকারকও হয়ে উঠছে। অতএব এখনও পর্যন্ত যারা সংক্রামিত হননি তাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। ধৈর্য ও একাগ্রতার সঙ্গে সুস্থ করে তুলতে হবে জনসাধারণকে নইলে আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, উন্নত জীবন, সুস্থ-সুন্দর চেতনার চিতা সাজানোর দিন আর বেশি দূরে নয়।
 
 
 
 

সংশ্লিষ্ট পোস্ট

আমার রবীন্দ্রনাথ
ভবেশ বসু

আমার রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ হলেন জ্ঞান ও বোধ। তোমাদের আঁচলে কি ? কি বাঁধা আছে ? জ্ঞান ও বোধ বেঁধে রেখেছো কেন ? আঁচলে চাবি গোছা।তার সাথে রবীন্দ্রনাথ।সকল মায়ের আঁচলে বাঁধা।সন্তান ছুটতে ছুটতে চলে এল।চোখে ঘাম।মুখে ঘাম।পায়ে ধুলা।ছেলে মেয়ের পৃথক গামছা।গামছায় ছেলে মেয়ে পরিস্কার হল।  মা ওদের তো রবীন্দ্রনাথ দিলে না ? রবীন্দ্রনাথ গামছায় নেই।রবী আছেন আঁচলে।

গদ্য৭ মে, ২০২৪
রঞ্জিত কথা - শঙ্খ ঘোষ
সব্যসাচী হাজরা

রঞ্জিত কথা - শঙ্খ ঘোষ

রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি-র সেই কথা মনে পড়ে –‘আমাদের ভিতরের এই চিত্রপটের দিকে ভালো করিয়া তাকাইবার আমাদের অবসর থাকে না। ক্ষণে ক্ষণে ইহার এক-একটা অংশের দিকে আমরা দৃষ্টিপাত করি। কিন্তু ইহার অধিকাংশই অন্ধকারে অগোচরে পড়িয়া থাকে’। সেই অন্ধকারে এঁকে রাখা ছবিগুলো যা রঞ্জিত সিংহ’র ভেতরে একান্ত ব্যক্তিগত হয়ে থেকে গিয়েছিলো, আমি সেগুলোকেই আলোয় আনতে চেয়েছি। ‘রঞ্জিতকথা’ তাই।

গদ্য৩০ আগস্ট, ২০২৪
 গাছ
হিমাংশু রায়

গাছ

চুপ করে বসে থাক আর শোন। গাছেরাও কথা বলে জানলাম কাল।  সকালে হাই তোলার মত করে গাছেরাও শব্দ করে শুকনো,ভেজা পাতাগুলোকে ঝেড়ে ফ্যালে সকালের প্রথম হাওয়ায়। তারপর একটু হাত পা নাড়িয়ে ব্যায়াম করে, সকালের রোদে। শুকনো ডালগুলোর মড়মড় আওয়াজ শুনলে বুঝবি।

গদ্য৭ মে, ২০২৪