প্রয়াস
রবীন্দ্রনাথের সমস্ত গানকেই কিছু পর্যায় বা পর্বে ভাগ করা হয়ে থাকে। যার একটি ‘স্বদেশ’ পর্যায়ের গান। সে গানের সংখ্যা খুব কম নয়। কারণ, রাজ ও সমাজনীতি নিয়ে কবির যথেষ্ট উৎসাহ তাঁর সাহিত্যকর্মের বিভিন্ন বিভাগেই লক্ষ করা যায়। সেক্ষেত্রে গান আরও বেশি কমিউনিকেটিভ। বাংলা বিভাজনকালে রবীন্দ্রসংগীত মানুষের মুখে-মুখে উচ্চারিত হত। আবার এই উপমহাদেশের তিনটি রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীতের রচয়িতাও তিনিই। সুতরাং তাঁর বেশকিছু গানের ভাবে স্বদেশ্চিন্তা মুখ্য হয়ে উঠবে, তা অস্বাভাবিক নয়। রবীন্দ্রগান কথার ভাব (লিরিক) ও সুরের সমন্বয়ে সৃষ্ট ভাবপ্রধান সংগীত। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করলে, তাঁর তিনটে সার কথার মান্যতা দিতে আমার কোনো অসুবিধা হয় না। বরং একটা স্বস্তি মেলে একাত্ম হতে পারায়। যেমন, ১)“গানের কবিতা, সাধারণ কবিতার সঙ্গে কেহ যেন এক তুলাদণ্ডে ওজন না করেন”। ২)“গানের কবিতা পড়া যায় না, গানের কবিতা শুনা যায়”। ৩) “এখন যেমন সংগীত শুনিলেই সকলে বলেন ‘বাঃ ইহার সুর কী মধুর’, এমন দিন কি আসিবে না যেদিন সকলে বলিবেন, ‘বাঃ কী সুন্দর ভাব!’”। এখানে স্পষ্ট হয় তাঁর সংগীতভাবনাটি, যেখানে ভাবকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। গানেও কবিতা থাকে, যাকে আমরা গীতিকবিতা বলি। কিন্তু নিক্তিতে মাপা সম্ভব হয় না, কোথায় গীতিটা বেশি, কবিতা কম, বা ঠিক তার বিপরীত! আমরা সে চেষ্টায় যাব না। পাঠ, অর্থাৎ চোখে পড়া, আর কানে শোনার মধ্যে একটা স্পষ্ট পার্থক্য আছে। আর সেটা শুধু ইন্দ্রিয়র নয়, একই ইন্দ্রিয়ের গুণের পার্থক্যও। এক ইন্দ্রিয় যেখানে মানসপটে ছবি আঁকতে ওস্তাদ, আরেক ইন্দ্রিয় সেখানে ছবি নয় ধ্বনির কারবারি, মস্তিষ্কে ধ্বনির নানারকম সিগন্যাল পাঠায়, যেখানে জড়িয়ে থাকে শ্রুতিমধুরতা বা বিশৃঙ্খলা্র প্রশ্নটি। সংগীতে ধ্বনিগুণের প্রাধান্য বেশি, ছবি উঠে আসার চেয়ে। এই ধ্বনিগুণের মধ্যে সুর-তাল-লয় পড়ে। কিন্তু শুধু তার বিশুদ্ধতা ও মোহিনীশক্তিই সংগীতের আরাধ্য হতে পারে না, যতক্ষণ না একটা ভাবের সুষম প্রকাশ ঘটে। এমন প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রগানের কথায় ভাব-প্রকাশক ভাবনা ও অনুভবের আলোচনাই হবে আমার প্রয়াস। এখানে স্বদেশ পর্যায়ের দুটি গান সম্পর্কে কিছু আলোকপাত।
গান ও গানকথা সম্পর্কিত
১) “আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে।
ঘরের হয়ে পরের মতন ভাই ছেড়ে ভাই ক’দিন থাকে?।
প্রাণের মাঝে থেকে থেকে ‘আয়’ ব’লে ওই ডেকেছে কে,
সেই গভীর স্বরে উদাস করে— আর কে কারে ধরে রাখে?।
যেথায় থাকি যে যেখানে বাঁধন আছে প্রাণে প্রাণে,
সেই প্রাণের টানে টেনে আনে— সেই প্রাণের বেদন জানে না কে?।
মান অপমান গেছে ঘুচে, নয়নের জল গেছে মুছে—
সেই নবীন আশে হৃদয় ভাসে ভাইয়ের পাশে ভাইকে দেখে।।
কত দিনের সাধনফলে মিলেছি আজ দলে দলে—
আজ ঘরের ছেলে সবাই মিলে দেখা দিয়ে আয় রে মাকে।।
স্বদেশ পর্যায়ের গানে রবীন্দ্রনাথ গানকথায় কিছুটা বাঁধনহারা। উন্মাদনার একটা রস যে তাঁর মধ্যে গড়াতে থাকত, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আবেগ তো যে কোনো সৃষ্টির মূলে। সেই আবেগ কখনো নিয়ন্ত্রণ করা হয় শিল্পের কারণে, আবার কখনো সেই আবেগে সৃষ্টিকর্তা কোথাও একটা অসম্ভব মিল খুঁজে পেয়ে ভেসে যেতেও পারেন। স্বদেশ তো মা। আবেগের মুল জায়গা এমনতর ধ্বনি। শুধু স্বদেশ কেন, এই ধরিত্রীই কবির মা। তার মধ্যে আবার বিশেষ একটি স্থান জন্মভূমি, যা স্বর্গাদপি গরিয়সী। সেই মা বন্দি, শিকলে বাঁধা, বিদেশি শাসনে পরাধীন জন্মভূমি তথা মা। তেমন এক প্রেক্ষিতে মায়ের ডাকে সবাই মিলিত হয়েছে। মিলনের কারন, ‘আয়’ বলে কারও আহ্বান; মিলনের উদ্দেশ্য হাতে-হাতে বেঁধে-বেঁধে থাকা। ভাই কেন ভাইয়ের থেকে দূরে থাকবে! যদিও যেখানেই যে থাক, ‘বাঁধন আছে প্রাণে প্রাণে’। প্রাণের টানই একত্রিত করে। অমোঘ এই টান, উদ্দেশ্য সাধু, কমন কজ, পরাধীনতা তথা মায়ের অসম্মাননা। প্রত্যেকে জানে প্রত্যেকের অন্তরের বেদনার কথা ও কারণ। তার বিরুদ্ধেই মিলিত হওয়ার উদাত্ত আহ্বান।
এই আহ্বানে কোনো উচ্চ-নীচ ভেদ নেই। মান-অপমান নেই। গর্জাবার আগে নয়নের জলও অন্তর্হিত। আশা জাগে, আলো উদ্ভাসিত হয় এমন সময়েই। ভাই ভাইয়ের পাশে অবস্থান নেওয়ায় তথা সাধারণ জনগণ একত্রিত হওয়ায় নতুন আশার সঞ্চার হয়। একত্রিত হওয়ার এই এক গুণ; প্রত্যেকে ভাবতে পারে, আমি একা নই, তাই দুর্বল নই। আমরা মিলিত, তাই আমাদের শক্তিও মিলিতরূপে বিরাজমান। কিন্তু এই মিলনপথ খুব কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। দীর্ঘ দিনের সাধনা, একে অপরকে ভাই বলে সম্বোধন করার কৌশল, পরিচয়ের জাত-পাত-সম্প্রদায়ের বেড়াজাল ভেঙে সমসম্মানে উজ্জীবীত হওয়া, কূপমণ্ডুকতা ছেড়ে পরস্পর আলিঙ্গনাবদ্ধ হওয়া, সাধারণ এক মহৎ উদ্দেশ্যে, এসবই সকলকে উদ্বুদ্ধ করেছে মিলনপ্রাঙ্গনে এসে মিলতে। মিলনের মুল উদ্দেশ্য, মাকে একবার দেখা, মায়ের প্রকৃত রূপটি স্পষ্টভাবে প্রত্যক্ষ করা। মা যে দুঃখিনী, মা যে অসম্মানিত, সেই বোধকে হৃদয়ে জাগ্রত করা।
গানকথায় যা উহ্য হয়ে আছে, তা বুঝে নিতে আর অসুবিধা হয় না। দুঃখিনী মায়ের দুঃখ মোচন, অসম্মানিত মায়ের সম্মান পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা, বেদনাহত মায়ের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলাই সন্তানের কাজ এবং আদর্শ। সেই আদর্শে উদ্বোধিত হওয়া সম্মিলীত সন্তানের দায়। সেই দায় তারা মেটাবে, এমনই প্রত্যাশা।
সম্মিলীত কণ্ঠস্বরে যখন এই গান গীত হয়, তখন যারা গায়, তাদের মধ্যে আবেগের রসধারা বর্ষিত হয়। আবার যারা শোনে তারাও একই রসধারায় সিক্ত হয়। এমনই এর গুণ ও মাহাত্ম্য। আজও এই গান প্রাসঙ্গিক। কারণ, রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেলেও মায়ের মুখের হাসি আজও মলিন নানাবিধ কারণে। সেই কারণগুলির সমাধা না-হওয়া পর্যন্ত এই গানের আবেদন ফুরোবে না।
২) বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান—
তুমি কি এমনি শক্তিমান!
আমাদের ভাঙাগড়া তোমার হাতে এমন অভিমান—
তোমাদের এমনি অভিমান।।
চিরদিন টানবে পিছে, চিরদিন রাখবে নীচে—
এত বল নাই রে তোমার, সবে না সেই টান।।
শাসনে যতই ঘেরো আছে বল দুর্বলেরও,
হও-না যতই বড়ো আছেন ভগবান।
আমাদের শক্তি মেরে তোরাও বাঁচবি নে রে,
বোঝা তোর ভারী হলেই ডুববে তরীখান।।
১৯০৫ থেকে ১৯১১ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ অনেকগুলি স্বদেশ পর্যায়ের গান লিখেছেন। বস্তুত বঙ্গভঙ্গের যে সিদ্ধান্ত, তার প্রতিক্রিয়া বিরোধিতা। এবং সেই বিরোধিতার বিস্তারে বেশ কিছু গান লিখে ফেলা, যার মুল সুরটি স্বদেশকেন্দ্রিক, বিশেষত স্বদেশের পরাধীনতা, শোষন-শাসন, শাসনের রোষ, রাষ্ট্রক্ষমতায় বলী শাসকের সাধারণ মানুষকে পদদলিত করার স্বেচ্ছাচার, ইত্যাদির বিরুদ্ধ ভাবনায় গানের পদসঞ্চার। আর একটা দিক হচ্ছে নিপীড়িত শোষিত লাঞ্ছিত সাধারণ মানুষকে একত্রিত করে স্বদেশমন্ত্রে দীক্ষিত করার গান।
উপরোক্ত গানকথায় তিনি এনেছেন দৈব বিশ্বাসের কথাও। ‘বিধি’, ‘ভগবান’ ইত্যাদি শব্দের প্রয়োগে যে ভাব উঠে আসছে, তাতে ভগবানকে ‘সর্বশক্তিমান’ বলে চিহ্নিত করে শাসক ও শোষক-কে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করছেন— ‘তুমি কি এমনি শক্তিমান!’ সর্বনাম ‘তুমি’-টা যে কে বা কারা, তা আর বলে দিতে হয় না। ‘বিধির বাঁধন’-টা কী এবং কেমন ধরনের তার একটা রূপরেখা তিনি রেখেছেন গানের ভেতর। সেগুলিকে সার্বিকভাবে মানবতাবাদীর কথাবার্তা। যেমন, ক) শাসক শোষকের কাজ হচ্ছে দুর্বলকে পিছে টানা ও দাবিয়ে রাখা, তা মানবতা বিরোধী, এর অবসান প্রয়োজন। খ) একদল মানুষের হাতে যেন জনসাধারণের ‘ভাঙা-গড়া’ তথা উত্থান-পতন-এর ভার অর্পিত। কিন্তু তা হওয়া উচিৎ নয়। কারও আঙুলের ডগায় নাচার জন্য আমজনতা নয়, তাহলে তার স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয়। ‘সর্ব বাধাহীন’ মানুষ চিন্তনটিই মানবতাবাদী। গ) শাসনের যে ক্ষমতা ও বল, তার আইন-কানুনে যতই ঘেরা হোক সাধারণকে, দুর্বলকে, তা অন্যায় মানবতা বিরোধী। অন্যদিকে সংগঠিত দুর্বলের বলও কম নয়। ঘ) সাধারণের সম্মীলিত শক্তিকে খর্ব করার সমস্ত রকম অপচেষ্টাই মানবতাবাদ বিরোধী, তাই অন্যায়। এবং এর ফল হচ্ছে সমূহ বিনাশ। এই মানবতাবাদ বিরোধী শক্তি যদি সম্মীলিত সাধারণের শক্তির চেয়েও বড়ো হয়, তাহলে রবীন্দ্র ভাবনায় আরও বড়ো এক ‘সর্বশক্তিমান’ আছেন অদৃশ্য শক্তি হিসেবে, যার কাছে নিস্তার নেই, মানবতা বিরোধীদের। সুতরাং, পতনের আগে সাবধান হও হে শক্তিমান শাসক ও শোষক।
গানকথায়, সাধারণের শক্তিকে তিনি খাটো করছেন না ঠিকই, কিন্তু সেই শক্তির চেয়ে শাসকের রাষ্ট্রীয় শক্তি বেশি হতে পারে। এই আশংকা থেকেই তাঁর দৈবের ওপর আস্থা। তাঁর ভাবনায়, পরমেশ্বরই সর্বশক্তিমান, এবং পরমেশ্বরই এই দুনিয়ার রক্ষাকারী, তাঁর কাছে উচ্চ-নীচ, সবল-দুর্বল, ইত্যাদির ভেদ নেই। তিনি সৎ-সাধু-সজ্জনকে রক্ষা করেন এবং দুস্কৃতির বিনাশ ঘটান। তাঁর প্রখর দৃষ্টিতে সর্বদা সবই ধরা পড়ছে। ফলে শাসক-শোষকের বিনাশ অবধারিত। আজকের দৃষ্টিভঙ্গিতে কারও-কারও মনে হতে পারে, তিনি সম্মীলিত শক্তির ওপর বিশ্বাস না-রাখতে পেরেই ‘বিধি’ ও ‘ভগবান’-এর কথা এনেছেন। অর্থাৎ দৈবশক্তির ওপর নিজস্ব বিশ্বাস স্থাপন করেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রভাবনায় এমনটা হতেই পারে। কারণ, প্রথমত তিনি পরমেশ্বরে বিশ্বাসী। দ্বিতীয়ত, তৎকালীন ভারতবর্ষে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় সশস্ত্র ইংরেজ শাসন, অপরদিকে নিরস্ত্র ভারতবাসী, এক অসম লড়াই। এটাও একটা কারণ হতে পারে।
এই গান শাসক-শোষক-উৎপীড়কের কাছে এক চেতাবনি, আর সাধারণ মানুষের কাছে এক সঞ্জীবন, আলোর রেখা। বার-বার শুনলেও গানটি পুরনো হয় না। আনন্দবিশ্বে মানুষ আনন্দময় হয়ে থাকুক, এমন ভাবনাতেই রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাসী। এই সব গান তারই প্রতিফলন।
সংশ্লিষ্ট পোস্ট
আমার রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথ হলেন জ্ঞান ও বোধ। তোমাদের আঁচলে কি ? কি বাঁধা আছে ? জ্ঞান ও বোধ বেঁধে রেখেছো কেন ? আঁচলে চাবি গোছা।তার সাথে রবীন্দ্রনাথ।সকল মায়ের আঁচলে বাঁধা।সন্তান ছুটতে ছুটতে চলে এল।চোখে ঘাম।মুখে ঘাম।পায়ে ধুলা।ছেলে মেয়ের পৃথক গামছা।গামছায় ছেলে মেয়ে পরিস্কার হল। মা ওদের তো রবীন্দ্রনাথ দিলে না ? রবীন্দ্রনাথ গামছায় নেই।রবী আছেন আঁচলে।
রঞ্জিত কথা - শঙ্খ ঘোষ
রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি-র সেই কথা মনে পড়ে –‘আমাদের ভিতরের এই চিত্রপটের দিকে ভালো করিয়া তাকাইবার আমাদের অবসর থাকে না। ক্ষণে ক্ষণে ইহার এক-একটা অংশের দিকে আমরা দৃষ্টিপাত করি। কিন্তু ইহার অধিকাংশই অন্ধকারে অগোচরে পড়িয়া থাকে’। সেই অন্ধকারে এঁকে রাখা ছবিগুলো যা রঞ্জিত সিংহ’র ভেতরে একান্ত ব্যক্তিগত হয়ে থেকে গিয়েছিলো, আমি সেগুলোকেই আলোয় আনতে চেয়েছি। ‘রঞ্জিতকথা’ তাই।
গাছ
চুপ করে বসে থাক আর শোন। গাছেরাও কথা বলে জানলাম কাল। সকালে হাই তোলার মত করে গাছেরাও শব্দ করে শুকনো,ভেজা পাতাগুলোকে ঝেড়ে ফ্যালে সকালের প্রথম হাওয়ায়। তারপর একটু হাত পা নাড়িয়ে ব্যায়াম করে, সকালের রোদে। শুকনো ডালগুলোর মড়মড় আওয়াজ শুনলে বুঝবি।