৩ নভেম্বর, ২০২৪
মিরাক্যাল
মিরাক্যাল

মাম্মা যখন জন্ম নেয় তখন মাম্মাকে প্রথম কোলে নেয় বড় ফু।মাম্মা বড় ফুপু বলতে শেখেনি ন'মাসে প্রথম পাপা বলতে শেখে।বড় ফুফু আর মাসি দুজনে মিলে সিগনেচার করেছিল বন্ডে।অনেক রিস্ক ছিলো মাম্মার জন্মের সময়। মাম্মার যেদিন জন্ম হয় সেদিন বড়পা মানে বড় ফুপাজি কাজে ছুটি নিয়েছিলেন।তিনি ফায়ার ব্রিগেডে কাজ করতেন।বড়পা আর বড়ফু দুজনেই ছিলেন হাসপাতালে। আর মাসি।মেসো তখন মহারাষ্ট্রে নিজের জব নিয়ে ব্যস্ত।

মাম্মার জন্মের সময় সিজারে প্রচুর ব্লাড পড়েছিল।রিস্ক ছিলো।
ডাক্তার রিস্ক নিতে চাননি।মস্তাক আহমেদ বলেছিলেন "আপনার স্ত্রী ভীষণ রকম অসুস্থ। কোনোরকম রিস্ক নেওয়া যাবেনা।আর হ্যাঁ ফ্যামিলির দুজনের বন্ড সই লাগবে।বাই দা ওয়ে আপনার স্ত্রীকে অন্যখানে নেওয়ারও সময় নেই। তাই যা করার তিন ঘন্টার মধ্যে করুন।"
প্রিয়া চক্রবর্তী মাম্মার মা। হিন্দু ফ্যামিলি বিলং করেন।এবং মস্তাক মুসলিম। ফলে দুপক্ষের অনেকেই বিয়েতে আপত্তি তুলেছিল।মেনে নিতে পারেনি।মস্তাকের পক্ষে শুধুমাত্র বড়দি মানে মাম্মার বড়ফুফু আর বড়ফুফাই মেনেছে।অন্যদিকে প্রিয়ার দিদি মানে মাম্মার মাসি আর মেসোই একমাত্র প্রিয়ার পক্ষে ছিলো।

আজকে যখন মাম্মার বয়স একবছর মাম্মা অনেক কিছু বলতে শিখেছে।মাম্মার জন্মদিনে কিন্তু সব আলাদা রকম ছিলো। সেদিন ডাক্তার এসে মস্তাককে বলেছিলেন "দেখুন আল্লাহ ভগবান কালী খৃস্ট যাকেই মানেন প্রার্থনা করুন।রুগী খুব ক্রিটিকাল।খুব মুশকিল আছে।প্রার্থনা করুন।"

 ২

মাম্মার কথাগুলো কেমন যেন।স্বাভাবিক নয়।প্রথম ন'মাসে ওর মা প্রিয়া বুঝতে পারছিল ভোকাল কর্ডে কিছু গন্ডগোল হচ্ছে।তারা কলকাতায় গিয়ে ডাক্তার দেখানোর কথা ভাবলেন।এবং সত্যি সত্যিই একদিন মাম্মাকে নিয়ে দুজনে ট্রেনে চেপে পড়লেন।ডক্টর স্বামী  চেন্নাইয়ের এপোলোর ডাক্তার। তিনি মাঝেমধ্যে কলকাতায় বসেন।যথাসময়ে মাম্মাকে দেখলেন। এবং বললেন ভোকাল কর্ডে সমস্যা হচ্ছে এন্ড ইট ক্যান বি কিউরেবল।বাট অল থিংস আর ইন হিজ হ্যান্ড।একটা অপারেশন করতে হবে বারো মাসে।এবং দ্বিতীয় অপারেশন তিনবছর বয়সে।আশাকরি এইট্টি পার্সেন্ট রিকভার হবে।

প্রিয়া সেদিন মস্তাককে নিয়ে দক্ষিণেশ্বেরে ঘুরে এসেছিলে। মনে মনে মাকে প্রণাম জানিয়েছিল।মা সব ঠিক করে দিও।

যথাসময়ে অপারেশন হলো।কিছুটা কাজ হলো। কিন্তু আরও ডেভেলপমেন্ট দরকার ছিলো।

বড়ফু বড়পা অনেক কষ্ট পেল।গানের লাইনগুলোও মাসাক কলি মাসাক কলি হলনা।

তিনবছরের মাথায় মাম্মা বেড়াতে গেল চেন্নাইতে।মাম্মা জানে গরমের ছুটিতে মা বাবা বেড়াতে এসেছে।একদিন মস্তাক প্রিয়া দুজনে রামেশ্বরম ঘুরে এলো।কি স্থাপত্য।কি অসাধারণ সব কারুকাজ।আহা কি সমুদ্র।
দেবতা কোথায় থাকেন?সমুদ্রকে জিগ্যেস করতে ইচ্ছে হলো।আর প্রার্থনা করতে ভোলেনি প্রিয়া।একটাই তো প্রার্থনা তার।

তখন ডক্টর স্বামী চেন্নাইয়ে। কলকাতায় আর বসেননা।তাকে পাওয়া গেল ওনার নিজস্ব চেম্বারে।উনি বললেন"অনেকদূর ডুয়ার্স শিলিগুড়ি থেকে যখন এসেছেন তখন বলেই ফেলি।অপারেশন এর পরে আগের থেকে ভালোও হতে পারে। আবার খারাপও হতে পারে। অপারেশন করাবেন কিনা ঠিক করুন।"

ফ্লাইটে ওঠার সময় মস্তাক প্রিয়াকে বললো "তুমি দেখে নিও মাম্মাম অনেক বড় গায়িকা হবে একদিন।আমার স্বপ্ন ছিল আমার মেয়ে গায়িকা হবে।এই স্বপ্ন একদিন সত্যি হবেই।দুজনের চোখে জল।দুজনেই সজল নয়নে মাম্মার দিকে তাকিয়ে।"ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হবে প্রিয়া।মাম্মামের অপারেশন প্রয়োজন নেই।অনেকদিন আগে শুনেছি আমাদের তোতলা মোয়াজ্জিন আজান দেওয়ার সময় তোতলায় না।
মাম্মাম আমাদের সেরকমই পবিত্র স্ত্রোত্র উচ্চারণ করবে।সে ক্লাসিকাল মিউজিক শিখবে।"
প্রিয়া হাতটা ধরে বললো "আমি তোমার পাশে আছি।"

 ৩

মাম্মা বড় হচ্ছিল তার ছোট্ট পৃথিবীতে।মাম্মার মনে আছে সে যখন পাঁচবছরের মাথায় স্কুলে গেল এক দিদি জিগ্যেস করেছিল তোরা মুসলমান না হিন্দুরে?মাম্মা উত্তর দিতে পারেনি।সে তখন এসব কিছুই বোঝেনা।বাড়ি ফিরে বাবাকে খেতে বসে জিগ্যেস করেছিল "পাপা আমরা হিন্দু না মুসলমান?"
পাপা অবাক হয়েছিল।বলেছিল "আমরা মানুষ।
এরপর যদি কেউ জিগ্যেস করে বলবি আমি মানুষ।"

কয়েকদিন পরেই রাতুল নামের এক তরুণ গান শেখাতে এলো মাম্মাকে।হিন্দুস্তানী ক্লাসিকের সঙ্গে রবীন্দ্রসংগীত নজরুলগীতি। বাংলা আধুনিক গান।মাম্মা গান শিখতে শুরু করলো।কিন্তু সব প্রতিকূলতা দূর হলনা।

অক্টোবর মাসে এলো বাঙালির সেরা উৎসব দুর্গাপূজা। পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপূজা মানেই ধুমধাম করে দেবি দুর্গার আরাধনা।যদিও শিলিগুড়িতে সাধারণত কেউই অন্যের ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামায়না।তবু প্রিয়ার কপালের সিঁদুর দেখে দূর্গাপুজার চাঁদা নিতে এসেছিল পাড়ার মহিলারা।রসিদে দাদাবাবুর নাম লিখবে বলে জিগ্যেস করতেই শোনে "মস্তাক আহমেদ লিখুন।"প্রিয়া উত্তর দিয়েছিল।
"ও।মুছলমান?"
ভদ্রমহিলার মুখ বেঁকে যায়।
"কেন?"
কেন'র উত্তর দেয়নি মহিলারা। চাঁদা নিয়ে চুপচাপ চলে গেছে।
প্রিয়া দশমীর দিন মাকে দেখতে গিয়েছিল মন্ডপে।প্রণাম করে এসেছিল মস্তাক সহ।

প্রিয়া একটা ছোট স্কুলে পড়াতো সেই স্কুল থেকেও তাকে ছাড়িয়ে দেওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা চালায় স্কুলের দুচারজন কলিগ। পরে মাম্মার মেসোর পরিচিত লোকাল কাউন্সিলারের হস্তক্ষেপে কিছু করতে পারেনি।

মাম্মা বড় হচ্ছিল।আস্তে আস্তে অনেকটাই রিকভার হয়েছিল।তবু কিছু শব্দ উচ্চারণে তার কষ্ট হচ্ছিল।

একদিন রবিবার ছিল।মস্তাক কলেজে পড়াতে যায়নি সেদিন।মাম্মাম কার্টুন দেখছিল।এমন সময় মাম্মামের বড় ফুপুর ফোন এলো।ফোনটা রিসিভ করে মস্তাক বলে

"হ্যাঁ বুজান বল।"
"ভালো আছিস?"
"ভালো আছিরে।তোরা কেমন আছিস?"
"আছি ভালো।
"শোননা।এরমধ্যে কালীপুজার ছুটি আছে নিশ্চয়ই কলেজে?"
"হ্যাঁ কেন?"
"আমি বলি কি,আজমের ঘুরে আয় একবার।ওখানে মাম্মামকে নিয়ে চাঁদর চড়িয়ে আয়।মাম্মামের নানির মারা যাওয়ার আগে শেষ ইচ্ছে ছিলো তোরা একবার আজমের ঘুরে আসিস"
"আচ্ছা।ঠিক আছে।আমার মনে আছে মা চাইছিল মাম্মামকে নিয়ে যাই।অবশ্যই যাবো।এবারে তো অন্য প্ল্যান নেই। দেখি প্রিয়া কি বলে।"
"আচ্ছা,ভালো থাকিস,রাখি তাহলে"বলে মাম্মামের বড় ফুপু ফোন রেখে দেয়।

বাগডোগরা থেকে জয়পুর তিনঘন্টার জার্নি প্রায়।ওখানে এর আগেও এসেছে প্রিয়া। জামাইবাবু যেহেতু রেলে চাকরি করে তাই মাঝেমধ্যেই এদিক সেদিকে যেতে হয়।দশছর আগে সেও এসেছিল দিদি, জামাইবাবুর সঙ্গে।

রাত বারোটার দিকে ওরা যখন আজমের স্টেশন পৌঁছালো মাজারের খাদেম সাহেব নিজে এসে তাদের রিসিভ করলেন।খাওয়া দাওয়া ঘোরা কোনো কিছুতেই অসুবিধা হয়নি।চাঁদর চড়ানোর সময় হাত তুলে দোয়া করতে গিয়ে চোখে জল চলে আসে মস্তাক আহমেদের।
প্রিয়া চক্রবর্তীর চোখেও জল।একটাই প্রার্থনা।একটাই চাওয়া মাম্মাম যেন অনেক বড় হয়।অনেক কথা বলে।আর সে যেন বড় গায়িকা হয়ে ওঠে।আর কিছুই চায়নি প্রিয়া।মাথায় করে চাঁদর বয়ে নিয়ে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি হাসান সঞ্জরির মাজারে চাঁদর চড়িয়ে দেয় মাম্মাম।

মাম্মাম নিজের মতো বড় হচ্ছিল।গান গাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছিল সেইসব কঠিন দিনগুলি।মাম্মামের স্পষ্ট উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে দুই পরিবারের সকল মানুষ যোগাযোগ করতে শুরু করে। এখন এসব আকছার হচ্ছে।দুটো মানুষ কি ভালোবেসে ঘর বাঁধতে পারেনা?মাম্মামকে দেখে দুই পরিবারের বড়রা বাধ্য হয় সব মেনে নিতে।




সেদিন টিভি দেখছিলাম।মা ডাকলো।"দ্যাখ দ্যাখ মেয়েটা দারুণ গাইছে।"

তাই?
হ্যাঁ।
মেয়েটার নাম জানো?
নাতো।
মেয়েটা তোমার নিস হয়।
কোন নিস?চশমাটা নিয়ে আয়।
আচ্ছা।
মাকে চশমাটা দিলাম।
মা তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে আছে টিভির দিকে।
"আরে এটা তো মাম্মা।"
হ্যাঁ।তুমি চিনতে পারোনি।অল ইন্ডিয়া ক্লাসিকাল মিউজিক কম্পিটিশন চলছে তাই তোমাকে ডেকে আনলাম।
মার চোখ থেকে জল পড়ছে।
মাম্মামের বড়ফু আজকে অনেক খুশি।

দিল্লির লালকেল্লার সামনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটতে কাটতে হৃদি বাবাকে বললো "আচ্ছা বাবা এখন নিশ্চয়ই আইসক্রিম খাওয়া যাবে?"
"হ্যাঁ যাবে।কম্পিটিশন তো শেষ।"
"হ্যাঁ খাবে নিশ্চয়ই। আমার জন্যও নিস রে।প্রিয়া হাসতে হাসতে মাম্মা মানে আমাদের হৃদিকে বললো।"
তারপর তিনজনে হাঁটতে থাকে লালকেল্লা প্রাঙ্গনে।

সেখানে অনেক মানুষের ভীড়। ভারতবর্ষের কোণা কোণা থেকে মানুষজন এসেছে।তাদের ভাষা আলাদা।তাদের খাদ্যাভ্যাস আলাদা। তারা কি বলছে বোঝা যাচ্ছেনা।

এক অদ্ভুত সঙ্গীত উঠে আসছে তাদের কলকোলাহলে।মৌমাছির মতো মানুষের ভীড় মানুষের বার্তালাপ।সেই ভীড়ের মধ্যেই কেউ হয়তো বলছে "বড়ফুপু, বড়ফুফা মাসি আমি গান করছি দ্যাখো,এয় মাসাক কলি এয় মাসাক কলি।।"

 

সংশ্লিষ্ট পোস্ট

সোয়েটার
অবিন সেন

সোয়েটার

গন গনে নীল শিখা মেলে গ্যাসের উনুন জ্বলছে। কেটলিতে জল সেই কখন থেকে ফুটে চলেছে। বাষ্প হয়ে অর্ধেক জল মরে গেছে। সেই দিকে কোনও খেয়াল নেই নীলার। সে একটা বেতের গদি মোড়া আরাম চেয়ারে বসে আছে। কিচেনটা ঢের বড়। প্রায় প্রমাণ সাইজ একটা ঘরের মতো। এখানে বসে উলের কাঁটায় শব্দ তুলে সোয়েটার বুনে যাওয়া তার একমাত্র বিলাসিতা। শীতের দিনে আগুনের এই উত্তাপটা কী যে আরামের, নীলা তা কাউকে বোঝাতে পারবে না। গ্যাসটা কতক্ষণ জ্বলছে সে দিকে তার কোনও খেয়াল নেই। চায়ের জল বসানোটা আসলে একটা ছুতো। শীতের রাতে আগুনের উষ্ণতাকে সে প্রাণ ভরে উপভোগ করে নিচ্ছে। গ্যাস পুড়ছে পুড়ুক। সেই নিয়ে সে মাথা ঘামায় না। তার স্বামী বিপুলের টাকার অভাব নেই। তারা বিশাল ধনী না হতে পারে কিন্তু এই সব সামান্য বে-হিসেবী খরচ করার মতো তাদের ঢের পয়সা আছে।

গল্প৭ মে, ২০২৪
এখানে আসবে না কেউ
রঙ্গন রায়

এখানে আসবে না কেউ

চেক - হ্যালো টেস্টিং - শুনতে পাচ্ছেন? শুনুন – জানালা দিয়ে হাওয়া ঢুকে গেল। ক্যালেন্ডারটা উড়ছে। দেওয়ালে ঘষটানির একটা শব্দ। পুরোনো বছর উড়ছে। আমি ৩১শে ডিসেম্বরে এসেই থমকে গেছি। বাইরে নতুন বছর চলছে, আমি পুরোনো বছরে। কীরকম অদ্ভুত লাগে। কাকতালীয় ভাবে দেওয়াল ঘড়িটাও বন্ধ। ব্যাটারি শেষ।

গল্প৭ মে, ২০২৪
অবনী বাড়ি আছো
পার্থসারথী লাহিড়ী

অবনী বাড়ি আছো

“আধেকলীন হৃদয়ে দূরগামী ব্যথার মাঝে ঘুমিয় পড়ি আমি সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া ‘অবনী বাড়ি আছ?”

গল্প৭ মে, ২০২৪