দুর্গাপূজা বাংলীর শ্রেষ্ঠ উৎসব। কথায় বলে বাঙালির ১২ মাসে ১৩ পার্বণ। কিন্তু বাংলায় উৎসবের চমক ১৬ আনা থেকে ১৮ আনায় পৌঁছে গেছে। দুর্গা পূজা তাদের মধ্যে অন্যতম। দুর্গা পূজার কথা শুনলে বাঙালির মনে প্রাণে আনন্দের জোয়ার নেমে আসে।
এই দুর্গাপূজার দেব দেবীর কাহিনী আমরা সকলে জানি। কিন্তু দুর্গাপুজো উৎসবকে কেন্দ্র করে বাঙালি যে আজ মেতে উঠেছে, সেই দুর্গা পূজা কবে থেকে শুরু হল সেটা তো অনেকেরই অজানা। আর এই অজানাকে জানার ইচ্ছা মানুষের চিরকালের আকাঙ্ক্ষা।
সমসাময়িক ৯০০ থেকে ১২০০ খ্রীস্টাব্দের মধ্যবর্তী পাল এবং সেন রাজা দের রাজত্ব বাংলাদেশে চলছিল। ঠিক সেই সময় বাংলায় দুর্গাপূজা প্রতিমার ভিত্তি প্রস্তর রচিত হয়েছিল।
তবে দুর্গাপূজা শুরু হয়েছিল ১৫০০ শতকের শেষের দিকে। ইতিহাস সূত্রে আমরা জানতে পারি দিনাজপুর বা মালদার জমিদার স্বপ্নাদেশ পেয়ে প্রথম দুর্গাপূজা শুরু করেছিলেন।
অন্য তথ্যসূত্র অনুযায়ী আমরা জানতে পারি ১৬০৬ সালে তাহেরপুরের রাজা কংস নারায়ন বা নদীয়ার ভবানন্দ মজুমদার বাংলায় প্রথম শারদীয় দুর্গাপূজা শুরু করেছিলেন। তাই আনুমানিক ধরা যেতে পারে ১৫০০ শতকের শেষ দিক থেকে ১৬০০ শতকের শুরুতে বাংলায় প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্গাপূজা আরম্ভ হয়েছিল।
এরপর ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভ করার পর রাজা নবকৃষ্ণদেব লর্ড ক্লাইভকে সম্মান জানাবার জন্য শোভাবাজার রাজবাড়িতে দুর্গাপূজার মাধ্যমে বিজয় উৎসবের সূচনা করেছিলেন।
বাংলা শাসন ক্ষমতা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালিত হওয়ায় কলকাতা হয়ে উঠে পূর্ব ভারতের প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র। ইংরেজরা জমিদারদের সাথে নানা ব্যবসা বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন। ব্যবসা-বাণিজ্যের ফলে সমাজে হিন্দু জমিদারদের প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং তারা প্রভাবশালী ধন সম্পত্তির মালিক হয়ে ওঠেন।
তাই ইংরেজদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে ও তাদের কৃপা দৃষ্টি অক্ষুন্ন রাখতে সেই সব শ্রেণীর মানুষেরা সমাজে নিজেদের বিত্ত বৈভব প্রদর্শনের জন্য দুর্গা পূজা শুরু করেন। তাদের কাছে দুর্গাপূজা হয়ে উঠে প্রধান ধর্মীয় উৎসব । ধনীর সংখ্যা যত বাড়তে থাকে তার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে দুর্গাপূজার সংখ্যাও। এই পূজাকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে শুরু হয় খরচ করার এক ধরনের অদম্য প্রতিযোগিতা।
অন্যদিকে গ্রামাঞ্চল গুলিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে নব্য জমিদারদের আবির্ভাব ঘটে। এই নব্য জমিদারদের উদ্যোগে পূজা তখন আশেপাশে শহরের গ্রামাঞ্চল গুলিতেও ছড়িয়ে পড়ে।
এই দুর্গাপূজার সময় বিদেশ বা ইংল্যান্ড থেকে কতজন সাহেব মেম আসছে তার উপর নির্ভর করত কোন জমিদার বাবুর কত দাপট। অন্যদিকে সাহেব বাবুরাও বিবি বাচ্চা সহ তারা সেজেগুজে বসে থাকতেন বাংলাদেশের দুর্গাপূজার নিমন্ত্রণের অপেক্ষায়।
এই উৎসবে সাহেবদের জন্য থাকত বিলাস বহুলতার বিভিন্ন ব্যবস্থা। কোথাও নাচ -গানের উন্মত্ততা, কোথাও বাইজিদের নাচ,কোথাও এলাহি খাবার-দাবাদের ব্যবস্থা, কোথাও বা পানীয়ের আসর। এসব কিছুর মুলে থাকত পুজোয় আসা আমন্ত্রিত অতিথিদের সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা। এই অতিথিদের জন্য প্রতি সন্ধ্যায় বিনো দনের জন্য গানের জলসা ঘরে বাইজি নাচ ও গানের আয়োজনের ব্যবস্থা থাকত। বিদেশ থেকে আগত অতিথিরা এই উৎসবকে জমকালো উৎসব বলে অভিহিত করেছেন। তবে এই পূজা ধনিক শ্রেণীর মানুষের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল। যদিও এক্ষেত্রে রানী রাসমণির দুর্গা পূজা ব্যতিক্রম ছিল।
তবে সময়ের সাথে সাথে বিত্তশালী জমিদার ও বাবুদের প্রভাব প্রতিপত্তির অবনতি হতে থাকে। ১৯৭০ সালে ভারতের হুগলি জেলার বলাগর গুষ্টিপাড়া বা গুপ্ত বৃন্দাবন পাড়ায় দুর্গাপূজো বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। সে সময়ে সেখানে ১২ জন বন্ধু মিলে দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। উর্দু ভাষায় বন্ধুকে বলা হয় ইয়ার। এই ১২ জন ইয়ার বা বন্ধু মিলে এখানে দুর্গা পুজা শুরু করেন বলে এই পূজাকে বারোইয়ারী বা বারোয়ারী দুর্গা পূজা বলা হয়। তবে ইতিহাসে অনেকেই এই পূজাকে প্রথম সর্বজনীন পূজা বলে অভিহিত করেন।
তবে এই প্রথম বারোয়ারি পূজা প্রসঙ্গে আমরা জানতে পারি এটি কেবল উৎসবই ছিল না ছিল সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে এক প্রকার বিদ্রোহ। কেননা তখন ধনিক শ্রেণীর মানুষ ছাড়া এই পূজা করার অধিকার সাধারণ মানুষের ছিল না। তাই এই পূজা যেন কোন ব্রাহ্মণ না করেন তার জন্য তাদের চাপ দেওয়া হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত এই পূজা সম্পন্ন করার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন এক নবীন ব্রাহ্মণ। সে যাই হোক প্রথম এই বারোয়ারী পূজার মধ্যে দিয়েই আমাদের দুর্গাপূজা জমিদারের প্রাসাদ থেকে বের হয়ে এসে আমজনতার উৎসব হিসেবে প্রথম পরিচিতি পেতে শুরু করে। মা দুর্গার এই পূজা হয়ে উঠে সকলের কাছে সর্বজনীন দুর্গাপূজা। এভাবে একক উদ্যোগে পূজা ধীরে ধীরে পরিণত হয় একাধিক জনের পূজাতে । তবে এই পুজো গণতান্ত্রিক রূপে শুরু হলেও তা সামন্ততান্ত্রিক রূপে ফিরে আসতে সময় লেগেছিল আরও বহুদিন।
১৮৩২ সালে কলকাতায় সর্বপ্রথম বৃহৎ পরিসরে বারোয়ারি দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়। এই পূজার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন কাসিমবাজারের রাজা হরিনাথ। ১৯১০ সালে এই পূজা সার্বজনীন দুর্গা পূজার রূপ নেয়। এক্ষেত্রে দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর অঞ্চল ও আদি গঙ্গার তীরবর্তী বলরাম বসুর ঘাট রোডের আদি বাসিন্দারা প্রথম অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
এর পরবর্তী ১৯১৩ সালে সিকদার বাগান এবং ১৯১৯ সালে নেবু বাগানের স্থানীয় অধিবাসীরা চাঁদা তুলে সার্বজনীন দুর্গাপূজার আয়োজন করেন । এভাবে সারা বাংলায় সার্বজনীন দুর্গাপূজার প্রচলন শুরু হয়। দুর্গা পূজার এই সর্বজনীন আয়োজন সমাজের নানা স্থানে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। পরবর্তীকালে অর্থাৎ আধুনিক যুগে সার্বজনীন শারদীয়া দুর্গাপূজা রুপে তা বাংলার সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠে।
সংশ্লিষ্ট পোস্ট
আমার রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথ হলেন জ্ঞান ও বোধ। তোমাদের আঁচলে কি ? কি বাঁধা আছে ? জ্ঞান ও বোধ বেঁধে রেখেছো কেন ? আঁচলে চাবি গোছা।তার সাথে রবীন্দ্রনাথ।সকল মায়ের আঁচলে বাঁধা।সন্তান ছুটতে ছুটতে চলে এল।চোখে ঘাম।মুখে ঘাম।পায়ে ধুলা।ছেলে মেয়ের পৃথক গামছা।গামছায় ছেলে মেয়ে পরিস্কার হল। মা ওদের তো রবীন্দ্রনাথ দিলে না ? রবীন্দ্রনাথ গামছায় নেই।রবী আছেন আঁচলে।
রঞ্জিত কথা - শঙ্খ ঘোষ
রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি-র সেই কথা মনে পড়ে –‘আমাদের ভিতরের এই চিত্রপটের দিকে ভালো করিয়া তাকাইবার আমাদের অবসর থাকে না। ক্ষণে ক্ষণে ইহার এক-একটা অংশের দিকে আমরা দৃষ্টিপাত করি। কিন্তু ইহার অধিকাংশই অন্ধকারে অগোচরে পড়িয়া থাকে’। সেই অন্ধকারে এঁকে রাখা ছবিগুলো যা রঞ্জিত সিংহ’র ভেতরে একান্ত ব্যক্তিগত হয়ে থেকে গিয়েছিলো, আমি সেগুলোকেই আলোয় আনতে চেয়েছি। ‘রঞ্জিতকথা’ তাই।
গাছ
চুপ করে বসে থাক আর শোন। গাছেরাও কথা বলে জানলাম কাল। সকালে হাই তোলার মত করে গাছেরাও শব্দ করে শুকনো,ভেজা পাতাগুলোকে ঝেড়ে ফ্যালে সকালের প্রথম হাওয়ায়। তারপর একটু হাত পা নাড়িয়ে ব্যায়াম করে, সকালের রোদে। শুকনো ডালগুলোর মড়মড় আওয়াজ শুনলে বুঝবি।