বাংলা বর্ণমালার শুরুতেই 'অ' কেন?
-নারায়ণচন্দ্র দাস
ভূমিকা -
বাংলা বর্ণমালার ধ্বনি-[=ধ্+ব+ন+ই=ধ্বনি=সদর্থক-ধারণা(ধ্)+বাহীর(ব)+সক্রিয়ণ(ই)+অনকৃত-(ন) যার ভিতরে], অর্থাৎ, বর্ণ-[=বরিত(ব)+আবর্ত্তিত(র্/রেফ)+(রহস্যময়ভাবে) টঙ্কারিত বা অনকৃত(ণ) যে ধ্বনি] -সমূহের, তথা, বর্ণমালার প্রতিটি বর্ণের লিপ্যন্তরিত রূপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে নিম্নলিখিত দার্শনিক ভাবধারা সম্পর্কে ন্যূনতম ধ্যানধারণা থাকলে, বর্ণরূপী শব্দসমাজের সদস্যদের সঙ্গে আমরা অতি সহজেই সখ্য-সম্পর্কে আবদ্ধ হতে পারি।]
[১] দ্বৈতাদ্বৈত-দর্শন আধারিত পুরুষ-প্রকৃতি-[টু-ইন-ওয়ান]-তত্ত্ব --
পুরুষ+প্রকৃতি=আধেয়+আধার=কণ্টেণ্ট+ফর্ম্ম=আত্মা+দেহাবয়ব;
পুরুষ=(পুং-বিষয়ক-ধারণা)=আধেয়=কণ্টেণ্ট=আত্মা;
প্রকৃতি=(স্ত্রীং-বিষয়ক-ধারণা)=আধার=ফর্ম্ম=দেহাবয়ব]।
প্রাণীদেহ=প্রাণশক্তির-আত্মা+প্রাণীর-দেহাবয়ব=দ্বৈতাদ্বৈত প্রাণী-অস্তিত্ব।
মনুষ্যদেহ=প্রাণশক্তির-আত্মা+দেহাবয়ব=দ্বৈতাদ্বৈতরূপী মানুষ।
আত্মা=আত্ম=আতম্=atom=আৎম=atmo; atmo+(sphere)=atmosphere-[মহাকাশের যে স্ফীয়ার- এ আত্মা(=আতম্/atom) বা আতম্-এর-(atom)-এর অণুকণারা ছুটে বেড়ায়]।
চরাচরে জড়াজড়ে ভর-বা-ভার-বাহী সমস্ত প্রকৃতিগুণসম্পন্ন অবয়বই ‘আত্মা’ ও ‘দেহাবয়ব’-এর এক একটি যুগ্ম বা যৌগ=প্র-[প্র-(কৃত/কৃতি)]=(প্+র)=সমর্পণের তথা প্রাপণের-(প্) লক্ষ্যে দ্বৈতাদ্বৈত সত্তা- দুটির পরস্পরের প্রতি আবর্ত্তন-(র্>রেফ))-এর/আকর্ষণের/আলিঙ্গনের সূত্রে বা সম্পর্কে আবদ্ধ; অর্থাৎ, পেয়ার্ড/pair/pairing/paired,’রি-পেয়ার্ড’/re-pair/re-paired/re-pairing; অর্থাৎ, ‘টু-ইন-ওয়ান’, বা, দ্বৈতাদ্বৈতরূপী-অদ্বৈত।
স্থান-কাল-পাত্র নির্ব্বিশেষে --
(ক) ব্যক্তিদেহের ক্ষেত্রে -
(১) নর-নারী-উভয়ের-দেহাবয়ব=প্রকৃতি=আধার=ফর্ম্ম=স্ত্রীং]; এবং,
(২) নর-নারী-উভয়ের-আত্মা=পুরুষ=আধেয়=কণ্টেণ্ট=পুং]।
(খ) সমাজ বা রাষ্ট্রদেহের ক্ষেত্রে --
(১) পরিচালক-শাসক/সরকার/রাজা (নারী-পুরুষ-নির্ব্বিশেষে)=পুরুষ(পুং)=আধেয়=আত্মা=কণ্টেণ্ট;
(২) পরিচালিত/শাসিত/কর্ম্মী/অধীনস্থ-প্রজাপুঞ্জ=প্রকৃতি(স্ত্রীং)=আধার=দেহাবয়ব=ফর্ম্ম্।’
[২] জগৎদর্শনের বিবর্ত্তনী তত্ত্ব --
জগৎ=জ+গ+ৎ=প্রবর্ত্তন-উৎপাদন-সৃজন-জনন-[জ]+আবর্ত্তন-গমন-[গ]+বৈপ্লবিক-উল্লম্ফন-[ৎ]। বা,
জগৎ=জ+গ+ৎ=origin-[জ]+development-[গ]+revolutionary change-[ৎ]।
[ক্রমসঙ্কোচিত অথবা ক্রমপ্রসরমান অসীম-অনন্ত-বিস্তারী আবর্ত্তনশীল পার্থিব ও জাগতিক ধারা-প্রবাহগুলি হ’ল -- কালের ধারা, সৃষ্টিধারা, গ্যালাক্সিধারা, নক্ষত্রধারা, গ্রহধারা, জ্ঞানধারা, ভাবধারা, চিন্তাধারা, জীবনধারা, কর্ম্মধারা, শিক্ষধারা, সংস্কৃতিধারা, বস্তুধারা, পণ্যধারা, প্রাণীধারা, পশুধারা, বৃক্ষধারা, মনুষ্যধারা, বংশধারা, রক্তধারা, জাতিধারা, বারিধারা, ঝর্ণাধারা, বায়ুধারা, তাপধারা, বিদ্যুৎধারা … … ইত্যাদি]।
[৩] নিরুক্তকার, বিশ্ববন্দিত-দার্শনিক ও মহামনীষী, যাস্ক কথিত মনুষ্যজীবনের ষ(ট)ড়-বিকার সংক্রান্ত ধারণা -- প্রাণশক্তির অদৃশ্য সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কণা থেকে ভূমিষ্ঠ-জনিত-ভবিত-ভূত-জাত রহস্যরূপী অস্তিত্বের -- বিশেষত দেহাবয়ব-বিশিষ্ট মানবাত্মার বিকারের রূপগুলি যথাক্রমে --
[এক] ‘জায়তে’ - (বিন্দু-রূপিণীর/অং-রূপিনীর=’অ’ বা ‘অং’-এর) জন্মলাভ বা জনিত হওয়া;
[দুই] [‘বিদ্যমানতে’] - বেঁচে-বর্ত্তে-বিদ্যমান-থাকা;
[তিন] [‘বর্দ্ধতে’] - বৃদ্ধিপ্রাপ্ত-বা-বিকশিত-হওয়া;
[চার] [‘পরিণীয়তে’] - দেহে-মনে পরিবর্ত্তিত-হওয়া;
[পাঁচ] [‘অপক্ষীয়তে’] - ক্ষয়িত-শীর্ণ-জীর্ণ-হ্রাসপ্রাপ্ত-হতে-থাকা
[ছয়] [‘বিনাশায়তে’] - অস্তিত্বের-(‘অ’-এর)-নির্য্যাস-(স্)-টুকু-(অস্=অঃ) সম্বল করে [মনুষ্য-জীবনের ষট-(ছয়)-বিকারের আবর্ত্তনচক্র পরিক্রমণের অন্তিম পর্য্যায়ে বিসর্গ-বর্ণের (ঃ) উপরিস্থ বিনাশ-বিন্দু অতিক্রম করে নীচস্থ বিন্দুটিতে কোন সূচনার ইশারা? সেটা কি বিশেষ বা বিপরীত সর্গের সূচনা-বিন্দু? নবরূপী অস্তিত্বের পরিক্রমণের চক্রবৎ ধারাটিকে চলমান রাখার ইঙ্গিৎ?!
[৪] সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অধ্যবসায়, ত্যাগ-তিতিক্ষায় ও উদ্যোগের ফসলের, প্রায়-বিলুপ্ত উদ্ধারপ্রাপ্ত ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন ধ্বংসাবশেষটুকু সম্বল করে পূর্ণাঙ্গরূপে “ক্রিয়া ও বর্ণভিত্তিক শব্দার্থতত্ত্ব’-[=Semantics’ part of ‘Illuminating linguistics’ or ‘Supralinguistics’ i.e. ‘Action-based meaningful phoneme-centric Semantics’]-এর বিনির্ম্মাণের (বিপুল-সংযোজনীসহ), তথা, পুনরুজ্জীবনের মত দুরূহ কার্য্য -- সহায়-সম্বলহীন কলিম খান ও রবি চক্রবর্ত্তী -- এই দুই দার্শনিক মনীষীর কাছে দুঃসাহসিক মৃত্যুঞ্জয়ী অভিযানের চেয়ে, কিংবা, যুগান্তকারী নবাবিষ্কারের চেয়ে, কোন অংশে কম ছিল না। প্রসঙ্গত, ‘ক্রিয়া ও বর্ণভিত্তিক শব্দার্থতত্ত্ব’ -এর সংক্ষিপ্ত কিছু কিছু দিক আলোচনার সুবিধার্থে তুলে ধরা হল --
(ক) প্রতিটি বর্ণই ধাতু ও ক্রিয়ার দ্যোতক; প্রতিটি বর্ণই ধারণাবাহী/অর্থধারী ধ্বনি এবং অখণ্ড বহুরৈখিক অর্থবাচকতায় সমৃদ্ধ। ভুল উচ্চারণে/বানানে কেজো জগতে কথোপকথনের কাজ চালান সম্ভব হলেও, লিখিত ভাষায় শব্দার্থের মর্য্যাদা রক্ষায় বানানের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ, বাংলাভাষার বর্ণ ও লিপি দীপ্তিরহিত ভাষার মত কেবলমাত্র ‘আওয়াজ বা উচ্চারণবাহী’ (Phonetic) এমন নয়; আমাদের বর্ণগুলির আওয়াজ ‘উচ্চারণ ও অর্থ’ উভয়কেই বহন করে (Phono-ideographic)। স্বভাবতই কেমন বানানে শব্দ লেখা হবে সেটা সাতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ প্রত্যেকটি বাংলা বর্ণই ‘ধাতু’, এবং ‘ক্রিয়া[-ভিত্তিক ও ‘অর্থ’বাহী। বর্ণার্থ জানা থাকলে অভিধানকোষ ছাড়াই শব্দের ভিতর থেকে শব্দের অর্থ নিষ্কাশন করা সম্ভব; এবং বর্ণসমবায় গঠন করে অর্থময় শব্দ তৈরী করাও সম্ভব।
(খ) বানান-সমস্যা সমাধানের নিয়মটি হল - “যে বর্ণ বা বর্ণসমবায় দিয়ে কোন শব্দ (গঠিত) লিখিত হয়, সেই বর্ণের বা বর্ণসমবায়ের অর্থ ও শব্দটির অভিধার্থ অভিন্ন হয়”। [স্থানাভাবে সমগ্র বর্ণমালার অর্থ এই নিবন্ধে পরিবেশন করা গেল না]।
(গ) ক্রিয়া স্বভাবতই অদৃশ্য; কার্য্যরত ক্রিয়াকারীর সম্মুখস্থ হলে, চক্ষুষ্মানের চোখে তা দৃশ্যমান হয়।
ঘ) ক্রিয়া ও বর্ণভিত্তিক শব্দের অর্থ বহুরৈখিক [যা প্রচলিত পাশ্চাত্যের ভাষাতত্ত্ব প্রভাবিত একরৈখিক-লোগোসেণ্ট্রিক-প্রতীকী শব্দার্থতত্ত্বের বিপরীত] হয়, অর্থাৎ, একই শব্দ অনেকার্থে ব্যবহৃত হতে পারে - উদাহরণ স্বরূপ ‘পদ’ শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ - ‘পালন(প) দান(দ) করে যে বা যাহা’। প্রেক্ষিত অনুসারে এই শব্দটি অজস্র অর্থে অজস্র সত্তাকে বোঝাতে সক্ষম।
(ঙ) সমজাতীয় তথা একই ক্রিয়া-বিশিষ্ট একটি শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক অর্থ বোঝাতে একাধিক বা বহু অ-সমার্থক শব্দ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এককথায়, সমার্থক শব্দের ধারণাটি ভ্রান্ত; কারণ একই ক্রিয়াসূচক বর্ণ ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের সঙ্গে অন্বিত হলে - রসায়ন বা রসায়ন-জনিত বিক্রিয়া - একই ভাবে কাজ করবে, কিংবা, একই অর্থ প্রসব করবে, এমন ধারণা বা সিদ্ধান্ত বিজ্ঞানসম্মত হতে পারে না। তাই, তেমন শব্দার্থগুলি ভিন্ন ভিন্ন ক্রিয়ার আঙ্গিকে অর্থবান হলেও সেইসব শব্দগুলিকে সমার্থক শব্দ বলা যায় না। উদ্দীষ্ট একই উদ্ভিদ, তবু - গাছ, বৃক্ষ, বিটপী, তরু, তৃণ, পাদপ ইত্যাদি প্রতিটি শব্দই ভিন্ন ভিন্ন ক্রিয়ার আঙ্গিকে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত ও গঠিত, অর্থাৎ, ভিন্নার্থবাচক।
‘ক্রিয়া ও বর্ণভিত্তিক শব্দার্থতত্ত্ব’-(=’Semantics’ part of ‘Supralinguistics’)-এর আলোকে ‘ক্রিয়া- ভিত্তিক ও বর্ণভিত্তিক বানানবিধি’ কী কাজে লাগতে পারে?
“(১) শব্দের ভিতর থেকে তার মানে বের করা যায়। (২) এক ক্রিয়াজাত শব্দ গুচ্ছ ধরে শেখা যায়। (৩) বাংলা শব্দভাণ্ডার সহজেই আয়ত্তে আনা যায়। (৪) বাংলাভাষার বিপুল ঐশ্বর্য্যের উপলব্ধি ঘটে। (৫) বাংলাভাষা বিষয়ে হীনন্মন্যতা থেকে মুক্তি ঘটে। (৬) দেশের প্রকৃত ইতিহাস জানা যায়। (৭) প্রবাদ- প্রবচন-ছড়া-জনশ্রুতি-আচার-সংস্কার ইত্যাদির মানে বোঝা যায়। (৮) রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণাদির প্রকৃত মানে বোঝা যায়। (৯) মনুষ্যত্বকে পূর্ণমহিমায় পুনরুদ্ধার করা যায়। (১০) সভ্যতার আদিম ইতিহাস পুনরুদ্ধার করাা যায়। (১১) যে ভাষাতত্ত্ব পড়ান হয় তা আগাগোড়া বদলে যাবে। (১২) ইংরেজী ভাষার শাসন থেকে বাংলা মনকে মুক্ত করবে। (১৩) ইংরেজীসহ সব ভাষাকে পথ দেখান যাবে”।
[কয়েকটি ব্যতিক্রমী অধেয়রূপী-(হসন্তযুক্ত, অথচ হসন্তহীনভাবে বর্ণমালায় আসীন)-বর্ণ বাদে বাংলা বর্ণমালার অধিকাংশ বর্ণই দ্বৈতাদ্বৈত (টু-ইন-ওয়ান) চরিত্রের, অর্থাৎ, উদ্দেশ্যত হসন্তহীন-প্রকৃতিরূপে (যা আদতে আধেয়-আধার বা পুরুষ-প্রকৃতির অদ্বৈত রূপ) লিপ্যন্তরিত করে বর্ণমালায় স্থাপন করা হয়েছে।]
‘অ্’-বর্ণটির অস্তিত্ব বর্ণমালায় নেই; সরাসরি অবয়বধারী অস্তিত্ব-[=অ=অ্+অ]-বান ‘অ’-বর্ণের অদ্বৈত রূপের ভিতরেই তার অবস্থান ও আবির্ভাব। যখন ‘অবয়বধারী-অস্তিত্ব’ বা ‘অ’ স্বয়ং আধারিত হওয়ার জণ্য ভিন্ন আধারের বা আশ্রয়ের প্রতীক্ষায় ব্যাকুল তখন ‘অ’-এর ভূমিকার বদল ঘটে যায়; ফলত ‘অ’ হয়ে যায় আধেয় এবং ‘আধার’-এর ভূমিকা পালন করতে এগিয়ে আসে ‘আ’। এইভাবে কর্ম্মযজ্ঞে কারকের ভূমিকা বদলে গেলে ‘আধার থেকে আধেয়’ বা ‘আধেয় থেকে আধারে’ রূপান্তরণ ঘটে যায়, অর্থাৎ, আধারবাচক বর্ণসমূহের ভূমিকা বা রূপ বদলাতে থাকে। অ, আ ছাড়া আরও ন’টি স্বরবর্ণের প্রত্যেকটি বর্ণকেই অস্তিত্ববান অ-এর বিকাশ ও পরিক্রমণ পথের পর্য্যায়ক্রমিক ভিন্ন ভিন্ন রূপের উপযোগী আধার-প্রদানকারী বর্ণের ভূমিকায় দায়িত্ব পালন করতে দেখব।
অর্থাৎ, আমরা দেখব -- (১) অবয়ব-প্রদানকারী আধাররূপী ‘অ’ যখন অন্য বৃহত্তর - আধার/আশ্রয়/ আলয়ের ভিতরে নিজেকে সমর্পণ করতে এগিয়ে যায়, তখন সে প্রথমেই ‘আ’-এর আধারে ঢুকে পড়ে; এবং এইভাবে (২) ‘অ/আ’-এর দিক থেকে একক বা যৌথভাবে সক্রিয়ণের/গতিময়তার/বিকাশের আধার হিসাবে ‘ই’-এর আধারে প্রবেশ; (৩) ‘অ-আ-ই’-এর একক বা যৌথভাবে ‘ঈ’-র আধারে প্রবেশ; (৪) ‘অ-আ-ই-ঈ’-রূপী অস্তিত্বের ‘নবরূপে উত্তরণের’ আধার হিসেবে একক বা যৌথভাবে ‘উ’-এর আধারে প্রবেশ; (৫) ‘অ-আ-ই-ঈ-উ’-এর একক বা যৌথভাবে ‘ঊ-এর’ আধারে প্রবেশ; (৬) আবর্ত্তনশীল হতে চেয়ে ‘অ-আ-ই-ঈ-উ-ঊ’-এর একক বা যৌথভাবে ‘ঋ’-এর আধারে প্রবেশ; (৭) এক দিশায় দিশাগ্রস্তভাবে চলনের লক্ষ্যে ‘অ থেকে ঋ’ পর্য্যন্ত প্রত্যেকটি আধারই একক বা যৌথভাবে আধেয়-রূপে ‘এ’-র আধারে প্রবেশ; (৮) বাড়-বৃদ্ধির কারণে এ-র ‘ঐ’-এর আধারে প্রবেশ; (৯) সার্ব্বিক লক্ষ্যপূর্ত্তির কারণে ‘অ থেকে ঊ’ পর্য্যন্ত প্রত্যেকটি আধারপ্রদানকারী সত্তাসমুহের ‘ও’-এর আধারে প্রবেশ; এবং (১০) বাড়-বৃদ্ধির কারণে ও-এর ‘ঔ’-এর আধারে প্রবেশ।
এছাড়া বর্গীয় ২৫টি বর্ণের মধ্যে দুটি বর্ণের [ক-বর্গের ৫ম ও চ-বর্গের ৫ম বর্ণ, অর্থাৎ, ‘ঙ’ এবং ‘ঞ’-এর ক্ষেত্রে ‘অ’-এর কোন ভূমিকা নেই; কারণ দুটি বর্ণই আদতে হসন্তযুক্ত-[কিন্তু হসন্তহীনরূপে বর্ণমালায় স্থাপিত]-অবয়বহীন অদৃশ্য-অংরূপিণীর রহস্যময়-ব্যঞ্জনার্থ-সম্পন্ন সানুনাসিক অনুস্বার- রূপে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
আরও একটি বর্ণ, ট-বর্গের ৫ম বর্ণ তথা ‘ণ-এর আচরণ ও ব্যবহার রহস্যময়তায় ভরপুর। ‘ণ’-বর্ণটি আধা-অদৃশ্য, আধা-দৃশ্য। আধা-অদৃশ্যতার কারণে এই অর্দ্ধমাত্রিক অবয়বধারী বর্ণটি শব্দের শুরুতে বসতে পারে না; স্বভাবতই তখন ণ্-এর সঙ্গে অবয়ব-প্রদানকারী ‘অ’-ও যুক্ত থাকে না; খণ্ড-ণ্-সত্তার প্রতিনিধি হিসাবেই তখন তার আবির্ভাব ঘটে। তবে, আধা দৃশ্যমানতার কারণে শব্দের মাঝে বা অন্তে অনুস্বার রূপে ব্যবহৃত বা টঙ্কারিত হতে তার কোন বাধা নেই, এবং, তখন ‘ণ’ অবয়বধারী অখণ্ড-ণ-[=ণ্+অ]-বর্ণের মর্য্যাদামণ্ডিত উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।
অনুস্বার-রূপে বর্গীয় বর্ণের আরও দুটি ৫ম বর্ণ, অর্থা্ৎ, ‘ন’ (ত-বর্গীয়) এবং ‘ম’-(প-বর্গীয়)-এর ভূমিকা লক্ষণীয়। তবে এই দৃশ্যগ্রাহ্য বর্ণ-দুটি সীয়ায়িত বা ক্ষুদ্রত্বপ্রাপ্ত হলেও অবয়বধারী, অর্থাৎ ‘অ’-যুক্ত এবং এই দুটি বর্ণই বর্গীয় বর্ণ হিসাবে পূর্ণ মর্য্যাদায় শব্দের শুরুতে/মধ্যে/অন্তে সর্ব্বত্র ব্যবহারের ছাড়পত্র পাবার অধিকারী, এবং অনুস্বার-(ং)-রূপেও শব্দের মধ্যে বা অন্তে ব্যবহৃত হতেও তাদের অবাধ অধিকার রয়েছে। দেখা যাচ্ছে অংশত মূর্দ্ধন্য-ণ, এবং পূর্ণত ‘ঙ’ আর ‘ঞ’ ছাড়া অবশিষ্ট বাইশটি বর্গীয় ব্যঞ্জ়নবর্ণই অবয়বধারী, অর্থাৎ, ‘অ’-এর কাছে ঋণী, এবং ‘অ’-ছাড়া তারা অস্তিত্বহীন বিদেহীমাত্র। অতএব, ‘অ’-এর অবলম্বন ছাড়া মর্ত্ত্যে অবতরণের কোন বিকল্প অবলম্বন তাদের জন্য খোলা নেই। যেমন - [ন্+অ=ন, ম্+অ=ম]।
অ-এর উপস্থিতি আছে এবং নেই, এমন যেসব ব্যঞ্জন-বর্ণকে বর্গীয় বর্ণের তালিকায় না রেখে বাইরে রাখা হয়েছে তাদের চারটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে -
(১) অন্তঃস্থ বর্ণগুলি [য-র-ল-ব] -- য-[=ই+অ যাওয়ন বা যাওয়া অর্থে ব্যবহৃত]; র-[=ঋ-জাত; আবর্ত্তনশীলের-রহণ-রক্ষণ অর্থে ব্যবহৃত]; ল-[স্বরবর্ণ থেকে স্থানচ্যূত, ব্যঞ্জনবর্ণরূপে পুনঃসংস্থাপিত ৯-এর বিকল্প ‘ল’-বর্ণরূপে ‘লালন-লওয়ন-লয়ন’-অর্থে ব্যবহৃত]; ব-[=উ+অ]-(=অন্তঃস্থ-’ব’) পূর্ণমাত্রায় অস্তিত্ববান কিন্ত, পৃথক দেহী-রূপে তাকে স্থাপিত না করে বর্গীয়-’ব’-এর রূপ ধার করেই তাকে তার ভূমিকা পালন করতে হয়। বহনকারী-বাহী,অতিবাহী, বৃদ্ধিবাহী, বিকল্পবাহী, অথবা, দ্বৈতাদ্বৈতবাহী অর্থে ব্যবহৃত]।
(২) ঊষ্ম-বর্ণসমূহ [শ-ষ-স-হ] -- [ঊষ্ম-(=উ+ঊ+ষ্+ম)-বর্ণ=উদ্লোক (উ) থেকে উদ্ভূত/আগত
দিশাগ্রস্ত (সীমায়িত=ম) শক্তির(=ষ্) আধার-রূপী-(=ঊ) যে বর্ণ/বর্ণসমূহ)]; -
শ-[=প্রযূক্ত-শক্তির-বিচ্ছুরণ থাকে যে আধারে]; ষ-[=দিশাগ্রস্তভাবে প্রযুক্ত শক্তির যোজন/বিচ্ছুরণ থাকে যে আধারে]।
স--এর দুটি অর্থে দুই রূপের অর্থ-ব্যাখ্যার কথা বলা দরকার। (এক) প্রথম অর্থ -- ‘স’=‘স’ত্তা-অস্তিত্বের সূচনাকাল থেকে ‘কণামাত্রেক যোজিত-শক্তিসম্পন্ন অবয়বধারী আধার, অর্থাৎ, ‘অং’-রপী/’অ-রূপী ‘সত্তা-অস্তিত্ব-ধারকের আদ্যক্ষর ‘স্’ থাকে, যার ভিতরে। অনন্ত শক্তিপুঞ্জের কণামাত্র শক্তি-সম্পন্ন এক একটি ‘স’ত্তা-’অ’স্তিত্বের [প্রতিনিধিত্বকারী বর্ণরূপে] আদ্যক্ষর ‘স্’-এর ব্যবহার থাকে যে আধারে। [সত্তা=স+ৎ+ত্+আ=সৎ-এর তারণ (ত্) থাকে যে আধারে-(আ)]। একদিক থেকে দেখলে ‘অস্তিত্ব’-এর ‘অ’, এবং, ‘সত্তা-অস্তিত্বের’ ‘স’ -- উভয়ের চরিত্র তুল্য-মূল্য সমান বললে সত্যের অপলাপ হয় না। যে-কোন অস্তিত্বের অবয়ব-কে ‘অ’ বলা গেলে মনুষ্য-জীবনের ক্ষেত্রে মনুষ্যরূপী ‘সত্তা-অস্তিত্ব’কে বা ‘সত্তা-অস্তিত্ব-সমূহকে ‘স’ দিয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে না পারার কোন কারণ নেই। প্রসঙ্গত বলা ভাল, প্রতিটি বাংলা বর্ণই প্রেক্ষিত অনুসারে একাধারে একবাচনিক যেমন হতে পারে, তেমনি বহু-বাচনিকও হতে পারে। প্রত্যকে সত্তাধারী-অস্তিত্বকে’ আমরা ‘স’-বর্ণে সম্বোধিত করতে বা অস্তিত্বের প্রতিনিধিত্বকারী সত্তারূপে গণ্য ও মান্য করতেই পারি। অতএব ‘স’-(স্+অ)-কে, অর্থাৎ, ‘সত্তা-অস্তিত্ব’-কে ‘অ’-এরই সমতুল শক্তিকণা-ধারক অস্তিত্ব বা সত্তারূপে গণ্য করতে পারি। (দুই) দ্বিতীয় অর্থ -- ‘স’ত্তাধারী-অস্তিত্বের বা ‘স’-এর আরেকটি রূপ তথা অর্থব্যবহার হল -- সত্তা-অস্তিত্বের বিলুপ্তির-প্রাক্কালে ক্রমান্বয়ে ক্ষয়-প্রাপ্ত যোজিত-শক্তির নির্য্যাসধারী সত্তা [=অঃ-রূপী বা অস্-রূপী সত্তা রূপেও ‘স’ ব্যবহৃত হয়ে থাকে]। প্রেক্ষিত অনুসারে -’স’-বর্ণের অর্থ-ব্যাখ্যা দুটি ব্যাখ্যার যে কোনটিকেই বোঝাতে পারে।
হ-[হ্+অ=হ]=শক্তিধারীর ‘হওয়ন’ বা ‘হ-করণ’ থেকে না-হওয়াকরণ বা হনন পর্য্যন্ত সর্ব্বপ্রকারের হ-করণ থাকে যাহাতে]।
(৩) অংশত বিন্দুরূপিণীর রহস্যময়তায় আবৃত বর্ণত্রয় [‘য়-ড়-ঢ়’] -- য়-[=গতি/(ই)+স্থিতি/(অ)=য। ‘ই-অ, ই-অ’ করতে করতে অর্থাৎ, এক-পা গতি-(ই)-তে আরেক-পা স্থিতি-(অ)-তে ভর দিয়ে একপা-দু’পা করে এগোতে থাকলে আমরা পেয়ে যাই, ‘য’-কে, [‘য’-রূপে এবং ‘য’-ফলা-রূপে] শুধুই যোজিত বা যুক্ত হওয়ার জন্য ‘যাওয়া’ অর্থে। ‘য’-এর নীচে বিন্দু বসিয়ে দিলে পাই ‘য়’-কে; তবে ‘য়’-এর ‘যাওয়া’ একরৈখিক না হয়ে রহস্যে মোড়া বহুরৈখিক হতে পারে শুধু নয়, ফিরে আসাও হতে পারে; এবং এই যাওয়া-আসার সম্মিলিত গতি-প্রকৃতি অংশত বিদিশাগ্রস্ত বা রহস্যরূপে-(.)-রঞ্জিতও হতে পারে। বিন্দুযুক্ত ‘ড়’-[=ডয়ন-উড্ডয়নের-(=‘ড’-এর) রহস্যরূপের টঙ্কার জড়িয়ে থাকে যে বর্ণে]; এবং বিন্দুযুক্ত ‘ঢ’-এর, অর্থাৎ, ঢ়-[=ডয়ন-উড্ডয়নের স্থিতিশীল রূপের (=’ঢ’-এর) রহস্যময় টঙ্কার-(.) জড়িয়ে থাকে যে বর্ণচরিত্রে]-এর ব্যবহার-বৈচিত্র্যের কারণে বাংলা বর্ণমালার সমৃদ্ধির স্বার্থে এই বর্ণ-দুটির গুরুত্বকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।
‘ঢ’-এর বিপুল ব্যবহার ত আছেই। কিন্তু, ‘ঢ়’-বর্ণের ব্যবহারিক সীমাবদ্ধতাকে আরও উন্মুক্ত ও প্রসারিত করে নতুন নতুন শব্দ তৈরীর কাজ অবহেলিত থেকে যাওয়া সত্ত্বেও ‘ঢ়’-কে উপেক্ষা করার মত মূঢ়তার পরাকাষ্ঠা দেখাতে বা তাকে বর্ণমালা থেকে উপড়ে ফেলে বর্ণ-সমাজ-সদস্যতা কেড়ে নিয়ে নির্ব্বাসনে পাঠানর মত হঠকারী, রূঢ় ও নিষ্ঠুর আচরণের কথা আমরা কখনই ভাবতে পারিনা ]।
(৪) খণ্ড-ত-(ৎ], অনুস্বার-(-ং), চন্দ্রবিন্দু-(ঁ), এবং বিসর্গ-(ঃ) -- খণ্ড-ত্-(=ৎ)-[বজ্র-বিদ্যুৎ-এর ঝলক ক্ষণিকের জন্য কখন কখন ঝলসে ওঠে এবং দৃশ্য-গ্রাহ্য হয়। ক্ষণ-মূহুর্ত্তটুকু ছাড়া সম্বৎসরের বাকী কাল জুড়ে সে-বিদ্যুৎ অদৃশ্যই থাকে। [‘উল্লম্ফন’ তথা ‘বৈপ্লবিক-পরিবর্ত্তন’ অর্থে, এবং তড়িৎ-এর মত ক্ষিপ্র ও দুরন্ত গতিময়তা বোঝাতে ‘ৎ’-বর্ণটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে]। ক্ষণিকের/মূহুর্ত্তের দৃশ্যগ্রাহ্যতার মত খণ্ড-ত-(ৎ)-এর এমন আকার-আকৃতি সৃজন করা হয়েছে যা দেখে মনে হতে পারে দুরন্ত ছুটে চলা একটুকরো বিদ্যুৎ-ঝলকের মতই তার চেহারা।
চন্দ্রবিন্দু অনুস্বার-বর্ণ ঠিকই, তবে পূর্ব্ববর্ণের মাথার উপরে তার অধিষ্ঠান। চন্দ্র/চাঁদ/চাঁদি=’চন্’-এর দান আবর্ত্তিত/বিচ্ছুরিত যাহাতে বা যা থেকে; অর্থাৎ যার দান আমাদের হৃদয়-মনকে চাঙা করে বা চনমনে করে, আনন্দে উদ্বেল করে বা আন্দোলিত করে - সেই ত চন্দ্র-চাঁদ-চাঁদি। বিন্দুরূপে আবির্ভূত বলে নাম চন্দ্রবিন্দু (ঁ)। ‘চন্দ্রবিন্দু’ অংরূপিণীর রহস্যময়তায় ঘেরা সানুনাসিক অনুস্বার-রূপে শব্দার্থের ব্যঞ্জনাকে ব্যাপ্ত-বিস্তারিত করে থাকে। অনুস্বার-(ং)-পরিবারের সাত সদস্যের প্রধান সদস্যই অনুস্বার-(ং); চন্দ্রবিন্দু ছাড়া বর্গীয় ব্যঞ্জনের পঞ্চম-সারিতে অবস্থানকারী অনুস্বার পরিবারের বাকী পাঁচ সদস্যরা হলেন - ঙ-ঞ-ণ-ন-ম।
বিসর্গ বর্ণ-দেহের লিপ্যন্তরিত রূপটিকে - বিসর্গ-বিন্দু-দুটিকে-(ঃ) আলম্বভাবে পরিবেশন করা হয়েছে; একটি উপরে, অপরটি নীচে। উপরের বিন্দুটি যেন বর্ত্তমান জীবন-সর্গের অন্তিম-বিন্দু বা বিনাশ-বিন্দু [=অঃ বা অস্]; আর নীচের বিন্দুটি যেন পরবর্ত্তী জীবন-সর্গে উত্তরণের তথা বিশেষ বা বিপরীত সর্গের শুরুতে থাকা ‘অ’-বর্ণেরই রূপান্তর-স্বরূপ অংরূপিণী/বিন্দুরূপিণীর সূচনা-বিন্দু [=অং বা অ]। বিসর্গের দুটি বিন্দুই আদতে অন[বচ্ছিন্ন, ওতপ্রোতভাবে আবর্ত্তনশীল মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের মত। ‘অং’ বা ‘অ’ থেকে ‘অঃ বা বিসর্গ-(ঃ) পর্য্যন্ত চক্রটি (=জীবন-চক্রটি) নিরবচ্ছিন্নভাবে চলমান।
[এই নিবন্ধ সঙ্কলনের কাজে, অংশত প্রচলিত অভিধাানগুলির মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রমী সর্ব্বাধুনিক অভিধানকোষ, মনীষী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ ছাড়া, সর্ব্বতোভাবে প্রচলিতের বিপরীতে বৈপ্লবিক, বিজ্ঞানসম্মত এবং অভিনব ‘ক্রিয়া ও বর্ণভিত্তিক শব্দার্থতত্ত্ব’-এর উদ্গাতা-স্রষ্টা মনীষীদ্বয় - কলিম খান এবং রবি চক্রবর্ত্তী - প্রণীত ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ (দুই খণ্ড) এবং অখণ্ড ‘সরল শব্দার্থকোষ’ গ্রন্থদুটিই আমার সর্ব্বোত্তম অবলম্বন ও পাথেয়।]
বাংলা বর্ণমালার শুরুতে ‘অ’ কেন?
[‘অ’-বর্ণের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভূমিকাংশটির মত অ’-এর সংজ্ঞা ও প্রকৃতি ব্যাখ্যাও কিছুটা দীর্ঘ হয়ে পড়ার পিছনে প্রথম কারণ, আমার সাহিত্যিক সীমাবদ্ধতা ও অক্ষমতা; দ্বিতীয় কারণ এমন বোধ ও বিশ্বাস - একবার ধৈর্য্য ধরে ‘অ’-বর্ণটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বা আত্মিক বন্ধন ঘটলে অবশিষ্ট বর্ণগুলির সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনের কাজটা সকলেরই অনায়াস-সাধ্য হয়ে উঠতে পারে।]
আলোকপ্রাপ্তির কাল থেকেই অখণ্ড ভারতবর্ষের প্রাচীন মনীষা এমন অভিজ্ঞান অর্জ্জন করেছিলেন
এবং আস্থাবান ছিলেন যে - পার্থিব তেজোময় অস্তিত্বসমূহ আর মহাবিশ্বের তেজোময় অস্তিত্বসমূহ - সবকিছুই অনন্ত-বিস্তারী সর্ব্বতেজের অধীশ্বর-রূপী ‘পরমা-প্রকৃতি’-সত্তার রূপভেদের প্রকাশ মাত্র। সর্ব্বাধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে-বলীয়ান আধুনিক বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন মহাবিশ্বের অস্তিত্বসমূহের দেহাবয়বাবৃত দৃশ্য-জগৎ অপরিমেয় মহাজগতের কিঞ্চিতধিক চার শতাংশ মাত্র। বাদবাকী পুরো মহাবিশ্বটাই অস্থির-দুরন্ত-ক্রমপ্রসরমান অস্তিত্বসমূহে পরিপূর্ণ হয়ে আছে, যার হদিশ এখনও অধরা- অস্পষ্ট এবং যার পোষাকী নাম ‘ডার্ক এনার্জ্জি’ ও ‘ডার্ক ম্যাটার’।
আমাদের বাংলাভাষাসহ অবশিষ্ট ভারতের অন্যান্য ভাষাতেও ‘অস্তিত্ব’ শব্দের শুরুতে ‘অ’-বর্ণের উপস্থিতি; আর অনস্তিত্ব ও অস্তিত্বসমূহের আন্তঃসম্পর্ক কিংবা শুধুই অস্তিত্বসমূহের আন্তঃসম্পর্ক বিষয়ে জ্ঞাত হতে চেয়ে এবং অজ্ঞাত অব্যক্ত অভিজ্ঞানকে বিজ্ঞাপিত, বিচ্ছুরিত, জ্ঞাত বা ব্যক্ত করার উদ্দেশ্যেই ত ভাষা-শব্দ-ধ্বনি-বর্ণ-লিপি-বানানবিধি-ব্যাকরণ-বৈয়াকরণের উদ্ভব, আয়োজন, এবং প্রয়োজন। আর আমরা এও দেখেছি, বর্ণমালার অর্দ্ধশত বর্ণের মধ্যে ‘অ’-বর্ণের ভূমিকা কত বিপুল এবং তার অপরিহার্য্য উপস্থিতি।
তুলনায়, ইংরেজী ভাষায় অস্তিত্ব-এর প্রতিশব্দ ‘এক্জিষ্টেন্স’-এর শুরুতে ই(E)-অক্ষরের ব্যবহার। [যদিও ফোনিম্ হিসেবে এর উচ্চারণ আমাদের ‘এ’-(A)-বর্ণের মত। কিন্তু কেন এক্জিষ্টেন্স-এর শুরু ‘এ’-অক্ষর দিয়ে তার কোন ব্যাখ্যা পাশ্চাত্য ভাষাবিদগণের কাছে আজও অজ্ঞাত। তাদের আজও স্থির বিশ্বাস এই যে, ‘অ্যালফাবেট’ হল অর্থহীন উচ্চারণ-সর্ব্বস্ব প্রতীকমাত্র]।
অবয়বহীন-অদৃশ্য অথচ দুরন্ত অস্তিত্বসমূহের আত্মা-(পুরুষ)-সমূহকে বা তাদের প্রতিনিধি-স্থানীয় আধেয়গুলিকেকে (=শব্দ বা ধ্বনির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অবিভাজ্য বরিত অনুকণাগুলিকে) ডাউনলোড করে, দেহাবয়বের অন্তর্গত করে, প্রকৃতিরূপে বা আধেয়-ধারী ‘আধার’-রূপে, হসন্তহীন-অবস্থায় ভাষার তথা শব্দের মৌলকণারূপ [ধারণা-(ধ্)+বহণ-(ব-ফলা) সক্রিয়ভাবে অনকৃত-(নি) যাহাতে=(-ধ্+ব+ন্+ই= ধ্বনি)] ধারণাবাহী-(=অর্থময়)-’ধ্বনি’-গুলিকে বরণ করে বর্ণসমাজের সদস্য হিসেবে মূর্ত্ত করে বর্ণমালায় পরিবেশন করা হয়েছে।
[তুলনীয়] - প্রজন্ম-পরম্পরায় কুমারটুলীর সুদক্ষ কারিগর-শিল্পীরা যেভাবে আধাররূপী দেহকাঠামর উপরে মাটির শরীর বানিয়ে তার ভিতরে দুর্গা, লক্ষ্মী বা সরস্বতীর অর্থময় ভাববৈশিষ্ট্যকে-(আত্মাকে) রঙ্-তুলির আঁচড়ে মূর্ত্ত করে তোলেন; আমাদের প্রাচীন ভাষাশাস্ত্রীরা তেমনিভাবে বর্ণ-দেহের আকৃতি- কাঠাম তৈরী করে, তার উপরে রঙ-তুলিতে অর্থময়-ধারণাধারী ধ্বনি-কণার ভাব-বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অক্ষর -লিপির প্রতিমূর্ত্তি তৈরী করে, ভাষা-প্রকাশের মূল উপাদানসমূহকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়ে আমাদের চিরঋণী করে গেছেন।
প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার - ‘অ’ থেকে ‘বিসর্গ(ঃ) পর্য্যন্ত বর্ণমালার প্রত্যেকটি বর্ণ একই সাথে বিন্দু- রূপিণী বা অং-রূপিণী প্রাণশক্তির ‘বিন্দুরূপ’-(সূক্ষ্ম-সঙ্কোচিত-সীমায়িত রূপ) ও ‘সিন্ধুরূপ’- (বিকশিত -ব্যাপ্ত-ক্রমপ্রসারিত-রূপ)। এককথায়, বাংলা বর্ণমালার মালাখানি আঁকা হয়েছে যা আসলে আমাদের জীবনের - ব্যক্তিজীবন, সমাজজীবন এবং জাগতিক জীবনের - চালচ্চিত্রকে ভাষায় মূর্ত্ত করার লক্ষ্যে বরণকৃত ও নিযুক্ত অর্দ্ধশত-সংখ্যক বিবর্ত্তনশীল নটবর-(=বর্ণরূপী-লিপ্যন্তরিত-অক্ষর-বর্ণ)-কে নিয়ে।
অস্তিত্ব নানা প্রকারের হতে পারে -- ‘দৃশ্য বাস্তব অস্তিত্বাদি’; ‘অদৃশ্য অথচ সক্রিয় বাস্তব অস্তিত্বাদি’; ‘কল্পলোকে/মনোলোকে/ভাবলোকে/ধ্যানে/ব্যবধানে কল্পিত, সৃজিত, আবির্ভূত অস্তিত্বাদি’; ‘ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অস্তিত্বাদি’; ‘সীমায়িত ক্রমহ্রাসমান বা ক্রমসঙ্কোচিত অস্তিত্বাদি’; মহাকাশের অসীমায়িত ক্রমপ্রসরণ -শীল অস্তিত্বাদি। অস্তিত্বময় দুনিয়া ‘জগৎ’ নামেও আখ্যাত হয়ে থাকে। ‘জগৎ’ শব্দেও অস্তিত্বের তিনরকম বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে - ‘প্রবর্ত্তন’/(জ), ‘আবর্ত্তন’/(গ), ‘উদ্বর্ত্তন’/(ৎ)। ‘স্থিতির সীমা ভেঙে প্রবর্ত্তন/ জনন/(জ) দিয়ে অস্তিত্বের যাত্রা শুরুর পর আবর্ত্তনশীল গমনপথ(গ) পরিক্রমণান্তে ‘উদ্বর্ত্তন’(ৎ)-এ পৌঁছে সে ‘গতি’কে ছোঁয়’। তাই এই দুনিয়া ‘জগৎ নামে খ্যাত’।
‘জগৎ’ শব্দে তিন রকম অস্তিত্বের খবর থাকলেও গতি-অগতি(স্থিতি)র নিরিখে সচরাচর স্থিতিময় ও গতিময় এই দু’ধরণের অস্তিত্বকেই বোঝায়। ‘উদ্বর্ত্তন’ হল স্থিতি ও গতির অন্তর্বত্তীকালীন এক আমূল পরিবর্ত্তন বা বৈপ্লবিক নৈরাজ্যময় পরিস্থিতি থেকে উল্লম্ফনের মাধ্যমে উদ্লোকে উত্তরণের মূহুর্ত্ত যা নবরূপে গতিপ্রাপ্ত হয়ে বর্ত্তিত হতে থাকে। ক্রমান্বয়ে ‘গতি-স্থিতি-গতি-স্থিতি…’-র আবর্ত্তনের এই রূপান্তরী-চরিত্রটিকে এককথায় ‘বিবর্ত্তনী-অস্তিত্ব’ বলেও ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে।
‘তাহলে, এখন ‘অ’-এর মানে কী দাঁড়াল? ‘অবয়ব দেয় যে’ (‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’)’। ‘ক্’ মানে ‘করণ’ বা ‘ক্রিয়া’; ক্রিয়া প্রত্যক্ষগোচর না হয়েও সক্রিয় বাস্তব। অবয়ব-(দেহ)-ধারী ক্রিয়াকারী ক্রিয়াশীল/সক্রিয় হলে তবেই ক্রিয়াকে (ক্-কে) প্রত্যক্ষ করা বা উপস্থাপন করা সম্ভবপর হয়। অতএব, আধারহীন অদৃশ্য হসন্তযুক্ত (ক্)-কে অবয়ব-(অ)-এর আধারে যুক্ত করার পরেই ক্রিয়া ও কারকের দ্বৈতাদ্বৈত (দ্বৈত+অদ্বৈত) রূপটিকে প্রকৃতিরূপে (‘অ্’+অ=অ) বা ক্রিয়া ও কারকের ‘অদ্বৈত’কে ‘অ’-রূপে মূর্ত্ত করে নিতে হয়। [তেমনভাবেই, ক্+অ=ক=(ক্রিয়াকারী কারক, প্রেক্ষিত-অনুযায়ী কারকসমূহের যে কোন একটি ‘কারক’); চ্+অ=চ (চয়নকারী চায়ী); ট্+অ=ট (টঙ্কারকারী টঙ্কারী); ত্+অ=ত (তারণকারী তারী); প্+অ=প-(প্রাপণকারী/পোষণকারী/পালনকারী পায়ী) …প্রভৃতি]।
“অতএব সংক্ষেপে ‘অ’=আছে যে; অস্তিত্ববান যে (which exists); [ন-কারী (চল>অচল); ব্যঞ্জনস্বরের অন্ত্যবর্ণরূপে ব্যবহৃত। (ক্+অ=ক=করে যে, চাল’ক’]। ‘অ’-এর সাহায্যে অনেক সময় সমগ্র অস্তিত্বকে বা অস্তিত্বসমূহকে বোঝান ছাড়াও অস্তিত্বের কাঠামকেও বোঝান হয়”। অস্তিত্বের যে দুটি ভাগ করা হয় - আধার(form), ও আধেয়(content), তার মধ্যে ‘অ্’ প্রধানত আধেয়কেই বোঝায়; অ প্রধানত ‘অ্’-এর আধারকেই বোঝায়। ‘অ’-এর বাড়-বৃদ্ধি হলে, ব্যাপ্ত বা প্রসারিত হতে চেয়ে বৃহত্তর আশ্রয়ের আধারে, অথবা, ক্রমব্যাপ্ত ‘আ’-এর আধারে আধারিত হতে থাকে। “ইংরেজীতেও আধার অর্থে (বাংলা ‘অ’-এর মত) ‘এ’-র অজস্র ব্যবহার [alive, alight, asleep, align etc] রয়েছে”।
অবয়ব-আধারিত [=হসন্ত(্)-হীন)] ‘অস্তিত্ব’ময় অধিকাংশ বর্ণগুলির গাঠনিক দিকটি আলোচনা করা যাক। অ্+অ (অবয়ব দেয় যে)=অ; ক্+অ=ক; চ্+অ=চ; ট্+অ=ট; ত্+অ=ত; প্+অ=প; য্+অ=য; শ্+অ=শ; ষ্+অ=ষ; স্+অ=স। লক্ষণীয়, প্রতিটি ক্ষেত্রেই হসন্তযুক্ত বর্ণগুলিকে অবয়ব প্রদান করেছে ‘অ’; তাই আরও একবার নির্দ্বিধায় বলা যায় ‘অ’-এর মুখ্য অর্থটি হল - ‘অবয়ব দেয় যে’’ (বঙ্গীয় শব্দকোষ’)।
‘অস্তিত্ব’ অথবা ‘অনস্তিত্ব’(=অদর্শন-হেতু সাধারণ্য যে-ধারণা প্রচলিত) উভয় শব্দের শুরুতে ত বটেই, এমনকি ‘অবয়ব’ শব্দের শুরুতেও ‘অ’-এর অবশ্যম্ভাবী উপস্থিতি লক্ষণীয়। আধেয়-রূপী অস্তিত্বন্ বা অনস্তিত্বন্-কে অবয়বরূপী আধার দেয় যে তাকেই ত ‘অস্তিত্ব’ বলে। আবার, অস্তিত্ব-কে বা ‘অ’-কে আধার বা আশ্রয় বা অঙ্ক-(=কোল) দেয় যে তাকে বলে ‘আ’। ‘আ’ ছাড়াও অবশিষ্ট ‘ই’ থেকে ঔ-পর্য্যন্ত স্বরবর্ণগুলিও অ’-কে আধার প্রদান করে থাকে।
দৃশ্য অস্তিত্ব বা অদৃশ্য-অস্তিত্ব তথা ‘অনস্তিত্ব’-এর আধার হিসাবে ‘অ’-এর প্রসঙ্গে শেষ কথাটি হল -- বর্ণসমাজের তথা বর্ণমালার প্রধান বর্ণ হিসাবে অন্য স্বরবর্ণগুলির সহায়তায় বর্ণ-সমবায়ে শব্দ তৈরীর কাজে সহযোগী অধিকাংশ বর্ণরূপী নটবরদের দেহাবয়ব-প্রদানকারী হিসাবে, এবং, ক্রিয়া-কর্ম্ম-যজ্ঞে কারকের ভূমিকায় তাদেরকে সক্রিয় সদস্য হিসাবে কর্ম্মজগতে প্রবেশের ছাড়পত্র-প্রদানকারী বরেণ্য বর্ণটি হল - ‘অ’। তাই বর্ণসমাজের আদ্য বর্ণরূপে প্রথমেই ‘অ’-এর অধিষ্ঠান।
“বলে রাখা যাক, আদিম মানুষ ‘অ’-ধ্বনি পেরিয়ে যখন কেবলমাত্র ‘অ-ই-উ’ উচ্চারণের যোগ্যতা অর্জ্জন করেছিল ও সুরে ডুবিয়ে এই তিনটি স্বরের সাহায্যেই তার সমস্ত বক্তব্য প্রকাশের কাজ চালাত, তখন একটি ‘অ’-বর্ণই তার বক্তব্যের এক-তৃতীয়াংশকে ধারণ করত। এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যাবে ‘বাংলাভাষা ও ভাষার উৎপত্তি রহস্য’ নিবন্ধে (দ্রষ্টব্য - কলিম খান ও রবি চক্রবর্ত্তী রচিত ‘বাংলাভাষা - প্রাচ্যের সম্পদ ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থ - ২০০৬)”।
‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এ প্রদত্ত ‘অ’-বর্ণের অর্থগুলি হল -
অ=’যে রক্ষা করে’; বিষ্ণু, ব্রহ্মা, শিব, বায়ু, বৈশ্বানর, ব্রহ্ম, সাদৃশ্য, অভাব, অক্রোধ, অলোভ, অহিংসা, অকর্ম্মক, অন্যত্ব, ভেদ, অকৃপা, অল্পতা, ঈষদর্থ, তুচ্ছতা, অপ্রাশস্ত্য, অবৈধতা, অকাল, অসময়, অলক্ষ্মী, অজ্ঞান …, …, অধিক্ষেপ, আক্রোশ, (নিষেধবাচক) ‘না’, অনুকম্পা, নিন্দা, সম্বোধন, বিষাদ, শোক …, …ইত্যাদি।
‘সরল শব্দার্থকোষ’-এ প্রদত্ত ‘ক্রিয়া-ও-বর্ণভিত্তিক’ অর্থগুলি -
“অ=আধার লাভ করেছে যে তেজাদি (জড়বৎ/অজড়বৎ শক্তিকণাদি) বা ‘আধেয়’গুলি; বা,
অ=অদৃশ্য (=দূরন্ত বলে অবয়বহীন) গতিকে বা গতিময়কে না-করণ করে দিলে (=স্থিতিরূপ ধারণ করলে) যার অবয়ব-প্রাপ্তি বা জন্ম ‘হ’য়; বা,
অ=হৃদগত হয়ে মনোলোকে স্থিত বা ভূমিষ্ঠ হয় যে; বা,
অ=যা থেকে জগতের সূচনা হয়ে থাকে। বা,
অ=‘যে রক্ষা করে’ (বঙ্গীয় শব্দকোষ)=(ব. শ.)। বা,
অ=অস্তিত্বমাত্র। বা,
অ=সত্তামাত্র। বা,
অ=আধেয়ধারী আধার যে। বা,
অ=অন্-(on)-করণ-কারী; ন-কারী, বা,
অ=না-(no)-করণ-কারী না-কারী, বা,
অ=কথার মাত্রা - ‘অ, তাই বুঝি’।”
[অবয়বধারী ‘অ’-এর বা অস্তিত্বের বাড়-বৃদ্ধি বা বিকাশের স্বার্থে ভিন্ন ভিন্ন অপরিহার্য্য অসীমায়িত ‘আ’শ্রয়/’আ’লয়/’আ’শ্রম বা সীমায়িত ‘আ’লয়/’আ’শ্রয়/‘আ’শ্রম বা আবশ্যকীয় যথোপযুক্ত ‘আ’-ধারে প্রবিষ্ট হতে হয় বা ‘আ’বরিত হতে হয় বা ‘আ’বেষ্টিত হতে হয়। সূচনার পর অবয়বধারী অস্তিত্বের বা ‘অ’-এর বিকাশন বা বিস্তারণের পরবর্ত্তী আশ্রয়, আশ্রম বা আধারসমূহ হল - আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ, এ, ঐ, ও, এবং ঔ।]
‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’-এ প্রদত্ত অর্থ ও অর্থব্যাখ্যা -
[অ=_/অব্ + ওঃ (ড) ক]।
“অ্=অস্তিত্বন্=অদৃশ্য আত্মা বা আধেয়/পুরুষ/আখ্যাত/ভাব/ক্রিয়া/ধাতু/(content)
অ=দেহাবয়ব=দেহ/অবয়ব-প্রদানকারী আধার=প্রকৃতি=স্ত্রীং=ফর্ম্ (form)।
অ=অ্+অ=আত্মা বা আধেয়-স্বরূপ অস্তিত্বন-(অ্)-কে আধার বা অবয়বরূপে(=অ) ধারণ করে যে। বা,
অ=আছে যে; অদৃশ্য-অথচ-সক্রিয় (১) বস্তুর আধার যে, অথবা (২) ভাব থাকে যে মননে/চিন্তনে। বা,
অ=অস্তিত্ববান যে। বা,
অ=ন-কারী; না-কারী। বা,
অ=অধিকাংশ ব্যঞ্জনস্বরের অন্ত্যবর্ণ রূপে ব্যবহৃত [ক্+অ=ক, প্+অ=প …ইত্যাদি।।
‘অ’-কে বহন করে যে, তাকে বলে অব। অর্থাৎ, রক্ষকের বা আধারের (অস্তিত্বের) নিম্নতম রূপকে ‘অ’-স্বরে বা ‘’বর্ণে চিহ্নিত করা হয়। এর ব্যক্ত রূপ হল ‘অং’ এবং ‘অঃ’।
অং=রহস্যরূপী অসীম শক্তির আধার-আধেয়র অদ্বৈত রূপ।
অঃ=সাধারণরূপী সসীম শক্তির আধার-আধেয়র অদ্বৈত রূপ।
অঃ আর অস্ একই কথা, অর্থাৎ, [অঃ=অস্]”।
“অস্তিত্বের অবয়বটি ‘অ’-এর দ্বারা এবং সসীম তেজ বা শক্তি-রূপটিকে ‘স্’-এর দ্বারা ব্যক্ত করা হয়।
তেজ যখন অসীম রহস্যরূপী সজীব তখন সে অং-(‘ং’)-রূপিণী। তেজ যখন বার্দ্ধক্যে উপনীত তখন সে ‘স্’ বা অস্(‘ঃ’)-রূপিণী। যতদূর বোঝা যায়, অস্তিত্বমাত্রেই জ্ঞাত বা অজ্ঞাত প্রবাহ থেকে ‘অব-তীর্ণ’ এক ‘ক্ষণিকের অতিথি’। তার আগে ও পরে শুধুই চলা। দাঁড়ায় (একেবারে ‘থ’ হয়ে দাঁড়ায় না, চলে, তবে নিয়মনিষ্ঠ নিজস্ব গতিতে, বা ধীর গতিতে), তখনই পাই অস্তিত্ব বা স্থিতি (=’অ’-কার =বিষ্ণু। দ্রষ্টব্য - ‘ওম’)।
তাই চলন-কে [চলন্=চল্+অন্(on)-কে] ন-(no)-করলেই ‘অ’ হয় বা অস্তিত্বের আত্মপ্রকাশ ঘটে। আবার অস্তিত্বমাত্রকেই ‘ন’ (no=negate) করে দিলে সে পুনরায় গতিশীল হয়ে যায়, অর্থাৎ, যে প্রবাহে ছিল সেই প্রবাহে চলতে থাকে নবীকৃত গতিতে। ‘অ’ তাই আধারের একক। এখান থেকেই গণনার সূত্রপাত। সেই কারণেই ইংরেজীতে A-বর্ণটি ‘একটি’ অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে”। এক একটি অস্তিত্বের চলন শুরু হয় তখন গণনার সাংখ্যমান হিসাবে ‘এক’-এর আবির্ভাব ঘটে”।
বাংলা বর্ণের সূচনা, অস্তিত্বের সূচনাবিন্দুর সমান্তরালেই সূচিত হয়; অর্থাৎ, বাংলা বর্ণমালার শুরু আদ্য-বর্ণ ‘অং’-এর ‘অ’-বর্ণ দিয়ে। আর, ক্রিয়া ও বর্ণভিত্তিক শব্দার্থতত্ত্বের আলোকে আমরা বলতে পারি - অস্তিত্ব-এর দিশাগ্রস্ত সূচনাবিন্দুকে অস্তিত্বের সাংখ্যমান বা সংখ্যার পরিমাণ বা একবাচনিক সংখ্যা হিসাবে বোঝাতেই ইংরেজী বর্ণমালার শুরু ‘‘A’-বর্ণ দিয়ে। বাংলা বর্ণমালার শুরু বিদিশাগ্রস্ত অসীম রহস্যরূপী সজীব তেজোময় অস্তিত্বের ধারক অবয়ব-প্রদানকারী ‘অ-বর্ণ’ দিয়ে”। ‘অ’ বা ‘অস্তিত্ব’ যেমন অখণ্ড-একককে সূচিত করতে পারে, খণ্ড-একক অস্তিত্বকেও সূচিত করতে পারে; তেমনি বিপুলা এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের অখণ্ড অনবিচ্ছিন্ন সামূহিক-অস্তিত্বের জগৎকেও একক অস্তিত্ব হিসাবে সূচিত করতে পারে’’।
“বস্তুত অনুস্বার (ং), সংস্কৃত বা সংস্কার-করা-রূপে যাকে লেখা হয় বিন্দু (.), তা হল এই বিশ্বের সমস্ত শব্দশক্তিজাত শব্দকণার বা শব্দের বিন্দু ও সিন্ধু রূপ। কিন্তু সে নিজে পৃথকভাবে উচ্চারিত হতে পারে না, তার জন্য তাকে ‘অ-ই-উ’ এবং তাদের সমষ্টিগত রূপ ‘ও’ প্রভৃতির সাহায্য নিতে হয়। সেই বিচারে (ং) হল একটি অব্যক্ত ধ্বনি বা বর্ণ। বিন্দুরূপিণীর প্রথম সাহায্যকারী (আগম) রূপে ‘অ’-এর আবির্ভাব। তাছাড়া, অঃ বা অস্-এর ভিতরে ‘অ’ যেন অস্তিত্বমাত্রেরই ব্যক্তকারী এবং ‘স্’ যেন তার শক্তির প্রতিনিধি - এভাবেও ‘অ’-কে প্রকাশিত হতে দেখি। যেন একটি জলবিন্দুর ভিতরে প্রাণের অস্তিত্ব বিপ্ বিপ্ করে প্রাণের অস্তিত্বের প্রকাশ ঘটাচ্ছে”।
অদৃশ্য আপাত-অস্তিত্বহীন (তথাকথিত ‘অনস্তিত্ব’ বা না-বাচক ‘অস্তিত্ব’রূপে যা অভিহিত) অথচ অস্তিত্বধারী সত্তা, দৃশ্য হ্যাঁ-বাচক অস্তিত্ব, এবং ‘অ’দৃশ্য না-বাচক অস্তিত্ব বা ‘অনস্তিত্ব’, আসলে যে অবিভাজ্য অনবচ্ছিন্ন একই আবর্ত্তনশীল অস্তিত্বের সূক্ষ্ম-সীমায়িত রূপ থেকে শুরু করে অনন্তপ্রসারী অসীমায়িত অস্তিত্বসমূহের রূপভেদের অজস্র চলচ্ছবি-মাত্র - এমন দৃষ্টিভঙ্গী্তে বা অখণ্ড-জীবনদর্শনে জারিত ছিলেন বলেই ভারতবর্ষের প্রাচীন ভাষাশাস্ত্রীদের পক্ষে এমন বিজ্ঞানসম্মত বর্ণমালার সারণী প্রস্তুত করা সম্ভব হয়েছিল। আমাদের আলোচ্য বাংলা বর্ণমালার অন্তর্গত বরিত বর্ণগুলির ‘আত্মা’কে (=অস্তিত্বন্-কে=’অ্’-কে) ডাউনলোড করে দেহ-কাঠামযোগে বা অবয়ব-(‘অ’)- যোগে ‘অ’-এর আকৃতিতে অন্বিত করে [অ্+অ=অ], প্রকৃতিরূপে মূর্ত্ত করার পর, বর্ণমূহের লিপ্যন্তরিত রূপধারী অমূল্য রত্ন-সম্পদ-সমূহকে ভাষিক সমাজের উদ্দেশে ভাষাশাস্ত্রীরা উপহার হিসাবে পরিবেশন করে গেছেন।
“তাহলে, ‘অ’-এর মানে সাধারণভাবে আমরা কি বুঝব? ‘অবয়ব দেয় যে’। সংক্ষেপে ‘অ’=আছে যে; অস্তিত্ববান যে (which exists); [ন-কারী (চল>অচল); অতএব, এককথায় ‘অ’-এর মানে দাঁড়ায় - ‘অস্তিত্বকে অবয়ব দেয় যে’, বা ‘অস্তিত্বকে আধারিত করে যে’। এ হল শুধুমাত্র ধরে রাখা। কিন্তু যাকে ধারণ করা হয়, তাকে লালন-পালন ও তার বিকাশসাধন করলে সে আধারের রূপ বদলে যায়”। [তবে সে আলোচনা এই নিবন্ধের বিষয় এবং আয়তনের দিক থেকে অপ্রাসঙ্গিক]।
উপসংহারে আসু্ন, আরও একবার আমরা দেখে নিই, ব্যঞ্জনবর্ণসমুহের ক্ষেত্রে ‘অ’-এর ভূমিকা। ‘ক্’ মানে ‘করণ’ বা ‘ক্রিয়া’; ক্রিয়া প্রত্যক্ষগোচর না হয়েও সক্রিয় বাস্তব”। অবয়ব-(দেহ)-ধারী ক্রিয়াকারী- (কারক) ক্রিয়াশীল হলে বা সক্রিয়ভাবে বিকাশশীল হলে তবেই ক্রিয়াকে-(ক্-কে) প্রত্যক্ষ করা সম্ভবপর হয়। অতএব, আধারহীন অদৃশ্য হসন্তযুক্ত-(ক্)-কে অবয়ব-(অ)-এর আধারে যুক্ত করার পরেই ক্রিয়া ও ক্রিয়াকারী কারকের দ্বৈতাদ্বৈত-(দ্বৈত+অদ্বৈত)-রূপটিকে প্রকৃতিরূপে (‘অ’-রূপে) ‘ডাউনলোড’ করে মূর্ত্ত করে তোলা সম্ভব হয়। অর্থাৎ, ক্+অ=ক=(ক্রিয়াকারী)-কারক। প্রেক্ষিত অনুযায়ী কারকসমূহের যে কোন ‘কারক’-কেই ‘ক্রিয়াকারী’ বা ‘কারী’ বলে চিহ্নিত করা যায়); চ্+অ=চ (=চয়নকারী চায়ী); ট্+অ=ট (=টঙ্কারকারী টঙ্কারী); ত্+অ=ত (তারণকারী তারী); প্+অ=প (প্রাপণকারী /পোষণকারী/পালনকারী পায়ী)…প্রভৃতি।
[নিবন্ধটি মৌলিক রচনা নয়। উদ্ধৃতাংশগুলি ছাড়া বাকী যা কিছু তার দায় ও দুর্ব্বলতা নিতান্তই সঙ্কলক-লেখকের।]
[এই প্রবন্ধটি ‘সকলের গান’, ওয়েবজিন, পুজো সংখ্যা ১৩৩১ এবং ‘বিহান’ শারদ সংখ্যা ১৩৩১-এ প্রকাশিত হল।]
- নারায়ণচন্দ্র দাস, সম্পাদক/’বঙ্গযান’।
(লেখাটি সকলের গান ওয়েবজিন পুজো সংখ্যা, ১৪৩১ এবং বিহান শারদ সংখ্যা, ১৪৩১ দুটোতেই প্রকাশিত হলো)
সংশ্লিষ্ট পোস্ট
আমার রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথ হলেন জ্ঞান ও বোধ। তোমাদের আঁচলে কি ? কি বাঁধা আছে ? জ্ঞান ও বোধ বেঁধে রেখেছো কেন ? আঁচলে চাবি গোছা।তার সাথে রবীন্দ্রনাথ।সকল মায়ের আঁচলে বাঁধা।সন্তান ছুটতে ছুটতে চলে এল।চোখে ঘাম।মুখে ঘাম।পায়ে ধুলা।ছেলে মেয়ের পৃথক গামছা।গামছায় ছেলে মেয়ে পরিস্কার হল। মা ওদের তো রবীন্দ্রনাথ দিলে না ? রবীন্দ্রনাথ গামছায় নেই।রবী আছেন আঁচলে।
রঞ্জিত কথা - শঙ্খ ঘোষ
রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি-র সেই কথা মনে পড়ে –‘আমাদের ভিতরের এই চিত্রপটের দিকে ভালো করিয়া তাকাইবার আমাদের অবসর থাকে না। ক্ষণে ক্ষণে ইহার এক-একটা অংশের দিকে আমরা দৃষ্টিপাত করি। কিন্তু ইহার অধিকাংশই অন্ধকারে অগোচরে পড়িয়া থাকে’। সেই অন্ধকারে এঁকে রাখা ছবিগুলো যা রঞ্জিত সিংহ’র ভেতরে একান্ত ব্যক্তিগত হয়ে থেকে গিয়েছিলো, আমি সেগুলোকেই আলোয় আনতে চেয়েছি। ‘রঞ্জিতকথা’ তাই।
গাছ
চুপ করে বসে থাক আর শোন। গাছেরাও কথা বলে জানলাম কাল। সকালে হাই তোলার মত করে গাছেরাও শব্দ করে শুকনো,ভেজা পাতাগুলোকে ঝেড়ে ফ্যালে সকালের প্রথম হাওয়ায়। তারপর একটু হাত পা নাড়িয়ে ব্যায়াম করে, সকালের রোদে। শুকনো ডালগুলোর মড়মড় আওয়াজ শুনলে বুঝবি।