ও কিছুটা আগেই। এটাই হয়। ও আগে থাকে। সর্ষেফুলের হলুদ মাখে তার এই এগিয়ে থাকা। সে সংবাদপত্র পড়ে কিনা জানিনা। সংবাদ হয়, এই মাঠের অমনিবাস আর হলদেটে নিমন্ত্রণ পেরিয়ে তার যাওয়া। আমি অনুসরণ করি। কেন, জানিনা। কবে থেকে মনে নেই। চায়ের কাপ আর ঠোঁটের ভেতরে যে কখনো সখনো পিছলে পড়া সেরকমই পিছল কিছু হয় এই ফলো করার সময়। চা ঠোঁটে আসেনা। সেও আসেনা তার পিছনে, তার ফিরে তাকানো আছে, ফেরা নেই। আমের মুকুলে কিভাবে এসেছে হাওয়াদার কোরিওগ্রাফি, তাতে মুক্ত বাজারের ছাপ্পা, এসব পেরিয়ে আর যেতে পারিনা। কোয়েলটা জানে। ডাকে। কোয়েলিয়া কোথায়...
ভাঙা ফ্লাইওভারের কাছে আবার, আমিও থাকি।সে বলে, তিতির। দু বছর হয়ে গেল। কেন ভেঙেছিল, আবছা। কে বা কারা দোষী, কেউ জানেনা। ভোট কয়েকটা ব্যক্তিগত কান্নাকে চাপা দিতে পারেনি। সমূহকে দিয়েছে। নেতা জল, আলো, দু’টাকার চাল ছুঁড়ে দিচ্ছে। জনতা খুব খুশি। তারা আর জানতে চায়না, কেন ভেঙে পড়ে, ভেঙে পড়লে কার কি যায় আসে, মৃত্যু এক আলোকপর্ণা টেমি হয়ে জ্বলতে থাকে। সে বলে, তিতির। আর তিতির তাকে শেষতক বুঝিয়েছিল, গ্লোবাল মেল্টডাউন এখন হতে থাকবে। অনিশ্চিত একটা ব্যবস্থাই পারে ভয় আর সন্ত্রাসকে ব্যবহার করে পুঁজিকে বায়বীয় করে তুলতে। দেখো, আগে জিনিসের দাম, গ্যাসের দাম, পেট্রোল ডিজেলের দাম বাড়লে লোকে বিক্ষুদ্ধ হত, প্রতিবাদ করতো। এখন করেনা। অর্থনীতির বায়বীয় স্তরে এটা হয়। তোমার চাকরি চলে গেছে। আবার হবে। তাছাড়া আমি তো আছি চাকরিতে। চলো আজ সেলিব্রেট করি। চাকরিকে...বলেছিল তিতির।
হাল্কা হয়ে আসা আলো মানেই চাপা পায়ে কেউ আসছে। নাকি তা নয়? সময়ের একেকটা খাপে শধু আটকে থাকে আসা, যাওয়া, চিৎকার, শীৎকার, অস্ত বা উদয়। আমার অনুসরণে কিছুই এসে যায়না। হলুদ যদি সর্ষে হয়, মাখনেও লাগে এক অন্য হলুদ, পিচ্ছিল। মস্কা মারার জন্য। ‘ছাপ তিলক সব ছিনি রে মোসে নয়না মিলাইকে’। আচ্ছা তো লোকটা। পুরুষ না মহাপুরুষ? তিতিরের বাবা ওকে বলেছিল, তিতিরকে একা কোরোনা, ওর ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের চাকরি তিতিরের আপাদমস্তক বামবিরোধী বাবার পছদ ছিলনা! স্ট্রেঞ্জ এনাফ, নো? ওর বাবা কি চাইতো মেয়ে পুঁজির বায়বীয় স্তরে না থেকে বরং সেই স্তরের মেজাজটুকুর আশ্রয়ে থাকুক। কলেজে পড়াক।সে, আমার বন্ধু, আমায় বলল, একটা মহানগর ভুলে গেল ভেঙে পড়ার যন্ত্রণা, ভুলে গেল যে যারা বা দায়ী তারা হয়ত আর একটা ফ্লাইওভার বানাচ্ছে বা প্রোমোট করছে কোথাও। তিতিরকে মেরে, মাংসই খাচ্ছে হয়ত কোন রেস্তোঁরায়। হাত সেঁকে নিচ্ছে রাজনীতির আগুনে। অনুসরণ আর শেষ হয়না। সেই কলকাতা থেকে উত্তরপ্রদেশের পাতিয়ালি। যাচ্ছি তো যাচ্ছিই। যো পিয়া আওন কহে গয়/ আজহু না আওয়ে স্বামী হো...
কে আসে আর কে যায়? তিতিরকে আমার বন্ধু খুঁজতে যেত, পাবেনা জেনেও। বলত, আমি একটা আওয়াজের ভেতরে থাকি সবসময়। ফুল সর্ষেকে হলুদ করার দিনেও ফাঁকা থেকে যায় একটা জায়গা। সেই ফুলাবৃত রাস্তা, সর্ষের খেত, কোকিলের ডাক অসমাপ্ত থেকে যায়। সে আসেনা। সে যায়ও না। খসরু লিখলেন। নিজামুদ্দিনের ঘরে ফাঁকা অপেক্ষা পড়ে থাকে। তিতিরের জন্য ফাঁকা পড়ে থাকে সে। অপেক্ষা থেকে প্রতীক্ষা অবধি আমি অনুসরণ করি তাকে।গ্লোবাল মেল্টডাউনের সময়ে যারা হাতের কব্জি খুঁড়ে শিরায় শিরায় পুঁজিকে হাওয়ায় মেশাচ্ছিল তাদের লুকনো অস্ত্রের ধার আমার ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলতেই আমি আর আমার বন্ধু ভেঙে পড়া ফ্লাইওভার থেকে সূর্যের আর্তনাদ কুড়িয়ে ফিরে আসি।
আর সে তখনো আগে।
বহত কঠিন হ্যায় ডগর পনঘটকি/ক্যাসে ম্যায় ভর লাউঁ মধওয়া সে মটকি/ মেরে অচ্ছে নিজাম পিয়া...ছিটকে ওঠে পথ থেকে, প্রান্তর থেকে অনিয়ন্ত্রিত নিজামুদ্দীনের প্রতি খসরুর টান। আজকের রিজিড দৃষ্টিভংগীতে মনে হবে সমলৈঙ্গিক প্রেম। এর বাইরে আর যেতেই পারিনা এখন। মেথডের বাইরে। স্ত্রী, পুরুষের শরীর এক হয়ে যেখানে মিশে যাচ্ছে নিজামুদ্দীন আউলিয়ার দরবারে, সেখানে মেথডিকাল প্রেম চলেনা। আমিও হাঁটতে হাঁটতে তার ছুঁতে থাকি সেতারের। সেতার থেকে খেয়াল, তবলা থেকে রাগ য়মন(ইমন) আমি কিভাবে ছোঁবো মানুষটাকে। প্রায় ন’শো বছর আগে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলা তার নাবালক আত বছরের সন্তানকে নিয়ে নিজামুদ্দীন আউলিয়ার ‘খানকাহ’তে ভর্তি করার জন্য।মা আর ছেলে এসেছে সুদূর পাতিয়ালা, উত্তরপ্রদেশ থেকে। নিজামুদ্দীন আউলিয়া তখন তেইশের কোঠায়। সেই ছেলেটি কিন্তু মায়ের আদেশ না মেনে নিজামুদ্দীনের পরীক্ষা নেবে ঠিক করল। মা বিরক্ত। ছেলে নাছোড়। সে মা’কে বলল, গুরু তাকে গ্রহণ করবে কিনা কেউ জানেনা। তাই সে একটি কবিতা লিখবে। গুরু অন্তর্যামী হলে ঠিকই ডেকে নেবেন তাকে। মা এই ছেলেকে ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা। ফার্সি, উর্দি, হিন্দভি আর সংস্কৃত এই বয়সেই শিখে ফেলেছে। গান লেখে, কবিতা লেখে। মা সত্যিই বুঝে উঠতে পারেনা এই বিস্ময় বালককে। চুপ করে থাকে। ছেলে মাকে দেখায় নিজামুদ্দীনকে লেখা তার কবিতাঃ ‘ তুমি সেই রাজা যার কাছে এসে পায়রাও বাজ হয়ে যায়/ এক গরীব ভ্রামক তোমার দরবারে এসেছে/ সে ঢুকবে না ফিরে যাবে?’ নিজামুদ্দীন টের পেলেন। কিভাবে কেউ জানেনা। তার এক মুরীদ বা শিষ্যের হাতে লিখে পাঠালেন, ‘ হে বাস্তবিক মানুষ, এসো/ আমার মুরীদ হও/ কিন্তু যদি ভাবো এখানে বোকারাই প্রবেশ পায়/ তাহলে ফিরে যাও, যে পথ দিয়ে এসেছ, সেই পথে’। ছেলেটি বুঝতে পারল সে ঠিক জায়গায় এসেছে। সে গেয়ে উঠল, ‘আজ রঙ হ্যায় , মা আজ রঙ হ্যায় রে/ মেরে মেহেবুব কে ঘর রঙ হ্যায় রে/ মোহে পীর পায়ো নিজামুদ্দীন আউলিয়া..’ শুরু হল দুটি সত্ত্বার একীকরণ। আমীর খসরু আর নিজামুদ্দীন আউলিয়া। এই কথাগুলো আমি আমার বন্ধুকে জানাই। যেদিন ফ্লাইওভার ভাঙল , আমার হাতে ছিল এই কথাগুলো। আমি পড়ছিলাম খসরুকে। আমি কিছুদিন পরে আরো বললাম, তিতির কোন মেয়ের নাম নয়, পাখির নাম নয়। তিতিরকে ভুলিসনা। তিতির অপেক্ষার ভেঙে পড়া, ভেঙে পড়ার অপেক্ষা। বন্ধু কি ভাবল জানিনা। তিতিরকে খুঁজতে খুঁজতে হারিয়ে ফেলল। আমীর খসরু, নিজামুদ্দীন আউলিয়া আর সৃষ্টি, এই যোগাযোগটা প্রাকৃতিক। আমার বন্ধু তিতিরকে পেলনা। মনবিক সম্পর্ক ব’লে? মৃত তিতিরের স্মৃতি ওকে বেঁধে ফেলছিল। আমীর খসরু আর আমার বন্ধু সমান্তরাল অচেনা দুটো চরিত্র। পাওয়া আর হারানোর মধ্যে হাঁটতে থাকা আমিও একজনকে আরেকজনের সাথে জুড়তে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেললাম। ‘পাওয়া’ কিন্তু ‘আসা’ আর ‘যাওয়া’র কোন ছেদবিন্দু নয়। এমনকি ফিরে পাওয়াও। নিজামুদ্দীন আউলিয়ার মৃত্যু সহ্য না করতে পেরে আমীর খসরু ছ’মাসের মাথায় তার পরম বন্ধু’র কাছে, ‘নিজাম পিয়া’র কাছে চলে গিয়েছিল। তিতির একটা অন্য প্রসঙ্গ। তিতিরের মৃত্যুও। আমি সেদিন আমীর খসরু পড়ছিলাম। সেদিনই ফ্লাইওভার ভেঙে পড়ল। এরপর খোঁজ। আমার বন্ধু আর একটা ভেঙে পড়া ফ্লাইওভার। মানবিক শোকের হয়ত অন্তর্নিহিত ইরেজার আছে। প্রাকৃতিক শোকের নেই। বন্ধু আরো কিছুদিন পরে জানালো, রুধিরার সঙ্গে ও থাকবে। তিতির হাজার হাজার টন সিমেন্ট, ইঁট, বালুর নিচে চাপা পড়ে গেছে আর হাঁসফাঁস করছে ও। রুধিরার নাকি সেক্সড্রাইভ দারুণ। বেটার দেন তিতির। মেধা কম। মেধা দিয়ে বিছানায় কী হয় বল? একটা ভাঙা ফ্লাইওভার দিয়েই বা কী হয়? মহানগরে শীতের সন্ধ্যা নামে। শীত, শীতিল শীত। লম্বা রাস্তাটা তানকানা। হিমের চাপে হু হু না করে ভারী ট্রাকের চাকার জন্য অপেক্ষা করছে।সবাই অপেক্ষা করছে। খসরুকে, আমীর খসরুকে এবার প্রায় ধরে ফেলেছি...
মনে হচ্ছিল। সামান্য দূরেই তখন। গেয়ে উঠলাম, ইস মোড় সে যাতে হ্যায়/ কুছ সুস্ত কদম রাস্তেঁ/ কুছ তেজ কদম রাহেঁ/ পত্থর কি হাওয়েলি কো, শিশে কি ঘরৌন্দো মে/তিনকোঁ কে নশেমন তক/ইস মোড় সে যাতে হ্যায়...রাগ য়মন বা ইমন। লোগ কহতে হ্যায় রাগ ‘য়মন’ আপকাহি দেন হ্যায়! খসরু সাব, মুড়কে তো দেখো! আচ্ছা আমি একটা ভুল সময়ে, ঠিক মানুষকে, ভুল করে খুঁজে যাচ্ছি নাতো? আমার বন্ধু, তিতিরকে খুঁজতে খুঁজতে রুধিরার কাছে চলে গেল। ঠিক সময়েই তো আছে ও। কাল্পনিক নয়। রুধিরা ভুল মানুষ কেন হবে? রুধিরার সম্পর্কে যা জানি সব আমার বন্ধু জানিয়েছে। রুধিরার মেধা নেই। তিতিরের আছে। এই পার্থক্যটা ধরার মত মেধা আমার বন্ধুর আছে তো?
আমি আমীর খসরুর একটা লেখা পড়তে পড়তে তিতির, রুধিরা আর আমার বন্ধুর ত্রিভুজে আটকে গিয়েছিলাম। এসব লেখার কথা নয় আমার। মেলাতেই পারছি না। কিভাবে সব ছেড়ে দিয়ে কেউ সবকিছু পায়। আবার কেউ সব পায়, কিছু না পেয়ে। এই চরিত্রগুলো বানানো। তাই আর টানতে পারছি না। প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পারছি না। অসহায়, বসে আছি। আমীর খসরু, মিস্টিক কবি। সুফিয়ানার পরশ দিয়ে খুঁজেছিল বিলীন প্রেমের রাস্তাগুলো। লেখাটা এরকমঃ
‘ সকল বন ফুল রহি সরষোঁ
সকল বন ফুল রহি
আমওয়া ফুটে, তেসু ফুলে, কোয়েল বোলে দর দর
আউর গোরী করত শৃংগার
মালানিয়াঁ গঢ়ওয়া লে আয়ি করষোঁ
সকল বন ফুল রহি...
তরহ তরহ কে ফুল লাগায়ে
লে গঢ়ওয়া হাথাঁ মে আয়ে
নিজামুদ্দীন কে দরওয়াজে পর
আওয়াঁ কহে গয়ে আশিক-রঙ
আউর বিত গয়ে বরষোঁ
সকল বন ফুল রহি সরষোঁ..’
এলোনা প্রেমিকপ্রবর বা আশিক-রঙ। সর্ষে ফুলের মরশুমে সেজে ওঠা মেয়েটিও আছে। রাস্তায় আছে অবাক করা ফুলের বিলিকরণ। সে, সেই প্রেমিক বলেছিল আসবে। নিজামুদ্দীনের দরজা খোলাই আছে। সে আসেনি।আর সেদিন এসবই পড়তে পড়তে ফ্লাইওভার ভাঙার আওয়াজ পেয়েছিলাম। ভয়ংকর আওয়াজ। ব্যস এতটাই। এরপর বানাতে শুরু করলাম। কেউ বলে গিয়েছিল এক্ষুনি আসবে। আসেনি। যেমন তিতির। তিতিরের স্বামী আমার বন্ধু। সে শোক পেল। হাহাকার পেল। শোক, হাহাকার খরচ হয়ে গেল তার। রুধিরা নক্ করছে তখন। আমি কবিকে অনুসরণ করতে শুরু করলাম। আসা আর যাওয়ার ‘মসলা’ বা ব্যাপারটা কী? কেউ আসে কেন , যায় কেন? কবিকে, আমীর খসরুকে জিগেগেস করি। কারণ কাকতালীয়ভাবে খসরুই পড়ছিলাম সেদিন। সেই ভেঙে পড়ার সময়ে...
মনে হয়ছিল এবার বলবো, কবি এবার দাঁড়াও। শুরু করেছিলাম হলুদের সর্ষেপনা দিয়ে। শেষে দেখলাম আঁচলাগা সোনার শেষ দেখে ছাড়ছে অস্তহলুদের রাস্তাগুলো। লম্বা হয়ে আছে অপেক্ষা। কবি আমীর খসরু একটা কাফেয় ঢুকল। তো, আমিও। কাফে’র একটা টেবিলে বসে আছেন আমীর খসরু। আছে রুধিরা, তিতির। তিতিরের মুখে-চুরুট বাবা আর আমার বন্ধু। আমি দূরে দাঁড়িয়ে রইলাম। কি হবে এবার? আমি জানিনা। আমিতো গল্প লিখছি না। আমি শুধু দেখছি, দেখে যাচ্ছি, সেই কবে থেকে...