৭ মে, ২০২৪
সোয়েটার
সোয়েটার

     গন গনে নীল শিখা মেলে গ্যাসের উনুন জ্বলছে। কেটলিতে জল সেই কখন থেকে ফুটে চলেছে। বাষ্প হয়ে অর্ধেক জল মরে গেছে। সেই দিকে কোনও খেয়াল নেই নীলার। সে একটা বেতের গদি মোড়া আরাম চেয়ারে বসে আছে। কিচেনটা ঢের বড়। প্রায় প্রমাণ সাইজ একটা ঘরের মতো। এখানে বসে উলের কাঁটায় শব্দ তুলে সোয়েটার বুনে যাওয়া তার একমাত্র বিলাসিতা। শীতের দিনে আগুনের এই উত্তাপটা কী যে আরামের, নীলা তা কাউকে বোঝাতে পারবে না। গ্যাসটা কতক্ষণ জ্বলছে সে দিকে তার কোনও খেয়াল নেই। চায়ের জল বসানোটা আসলে একটা ছুতো। শীতের রাতে আগুনের উষ্ণতাকে সে প্রাণ ভরে উপভোগ করে নিচ্ছে। গ্যাস পুড়ছে পুড়ুক। সেই নিয়ে সে মাথা ঘামায় না। তার স্বামী বিপুলের টাকার অভাব নেই। তারা বিশাল ধনী না হতে পারে কিন্তু এই সব সামান্য বে-হিসেবী খরচ করার মতো তাদের ঢের পয়সা আছে।

     তবে বিপুল কী কাজ করে নীলা জানে না। বিপুল বলেছে সে ব্যবসা করে। কী ব্যবসা নীলা জানে না। তার কাজে মাঝে মাঝে তাকে অনেক রাত করে বাড়ি ফিরতে হয়। আগে নীলা অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ত। কিন্তু অপেক্ষা করাই সার। বিপুল অধিকাংশ দিনই বাইরে খেয়ে বাড়ি ঢুকত। কোনও দিন হয়ত বিপুল মাঝ রাতে বাড়ি ফিরে আবার বোতল খুলে বসে। তখন নীলা রাগ করে রাত্রে না খেয়াই শুয়ে পড়ত। কিন্তু এখন অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। সে আর বিপুলের জন্যে না খেয়ে অপেক্ষা করে না। সে নিজের মতো খেয়ে শুয়ে পড়ে। কিংবা শোবার ঘরে রকিং চেয়ারে বসে উল বুনতে থাকত। ভাবত আকাশ পাতাল। প্রথম প্রথম তার ভীষণ আক্ষেপ হত। কতো বড় একটা ভুল সে করে বসে আছে। বাড়ির সবার অমতে সে বিপুলের সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করেছে। তার বাবা কোনও দিনই মেয়ের এই অবাধ্যতা মেনে নেয়নি। কিন্তু নীলা তখন হ্যান্ড-সাম বিপুলের প্রেমে অন্ধ। মন হরণকারী প্রেমিক বলতে যা বোঝায় বিপুল তেমনই। কী এক দুর্নিবার আকর্ষণে সে মেয়েদের আকর্ষণ করে নিতে পারে। নীলা বুঝতে পারে, বিপুলের আরও প্রেমিকা আছে। অনেক রাত করে যখন বিপুল ঘরে ফেরে তখন নীলা যেন টের পায়। কী এক উজ্জ্বল পরিপূর্ণতা দেখতে পায় সে বিপুলের চোখে। আজকাল বিপুল মাঝে মাঝে মাঝে বড়ি ফেরে না। তাকে নাকি ব্যবসার কাজে ট্যুরে যেতে হয়। তবে বিপুলের রোজগার আগের থেকে অনেক বেড়ে গিয়েছে। নীলা চাইলেই এখন দু-হাতে টাকা ওড়াতে পারে।

     তবে নীলা আর এতো ভাবে না। সে যেন এখন অন্ধের মতো হয়ে গিয়েছে, বন্ধু বান্ধবহীন এক অন্ধ মানুষ সে।

     ফুটন্ত জলের সোঁ সোঁ শব্দে হঠাৎ তার সম্বিৎ ফিরে আসে। নীলা ভেবেছিল বিপুল ফিরলে এক সঙ্গে চা নিয়ে বসবে। সেই জন্য সে চায়ের জল চড়িয়ে উল নিয়ে বসেছিল। কিন্তু বিপুল ফেরেনি। নীলাও চায়ের জল নামানোর কথা ভুলে গিয়েছে।

     নীলার উল বোনার অভ্যাস অনেক দিনের। এটা তার একটা হবি। তবে আগে সে তাদের শোবার ঘরে রকিং চেয়ারটায় বসে উল বুনত। কিন্তু এখন সে ওই ঘরটাকে এড়িয়ে চলে। কেন? ভয়? হ্যাঁ নীলা ভয় পেয়ে গিয়েছে।

     নীলা একদিন বন্দুকটা দেখল। সেদিন সে ওয়ারড্রবটা গুছিয়ে নেবে ভাবল। বিপুলের জামা প্যান্টের আড়ালে সে জিনিশটা দেখতে পায়। কালো চকচকে ভারি জিনিসটা দেখে সে ভয় পেয়ে যায়। অবাকও। এটা এখানে কেন? সে নিজেকে বার বার প্রশ্ন করেও উত্তর পায় না। সে কিছু বুঝে পায় না। সে স্থবিরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। জিনিসটা সে একবার ছুঁয়ে দেখে। হিম নিষ্ঠুর এক স্পর্শ যেন। হাতে নিয়ে সে যন্ত্রটিকে আবার যথাস্থানে রেখে দিয়ে ভাবছিলজিনিসটা সে আবার ধরবে কি ধরবে না! এমন সময়ে বিপুল ঘরে ঢোকে। ওয়ারড্রবের আর একটা পাল্লার আয়নায় সে বিপুলের দীর্ঘ প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। তার গলার স্বরে নীলা চমকে ওঠে।

     না, না, হানি ওটাতে হাত দিও না।

     বিপুলের গলার স্বর মাখনের মতো মোলায়েম কিন্তু বরফের মতো হিম।

     বিপুল পিছনে এসে শক্ত করে নীলার হাতটা ধরে। তারপরে ঘাড়ের কাছে মুখ নামিয়ে চুমু খাবার ভঙ্গি করে।

     কিন্তু নীলা বুঝতে পারে এটা হিংস্রতা। তবু নীলার কিছু করার নেই, সে দুই কঠিন হাতের ফাঁসে বন্দী হয়ে গিয়েছে। বিপুল কঠোর এক ভঙ্গিতে নীলাকে তার দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বুকের সঙ্গে চেপে ধরল এক হাতে। আর অন্য হাতে রিভলভারটা ধরে তার নলটা নীলার রগে ঠেকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

     হানি, এই জিনিসটা তোমার খেলার জিনিস নয়। এটার থেকে যত দূরে থাকবে ততই তোমার পক্ষে ভালো। জিনিসটা ছোট কিন্তু সাপের মতো ভয়ঙ্কর।

     বিপুল তার সিগারেট গন্ধী পুরু ঠোঁটটা নীলার ঠোটের উপরে নামিয়ে আলতো করে কামড়ে দেয়। একবার নয়। আর একবার। এবার বিপুলের দাঁতের ধার টের পায় নীলা তার ঠোঁটের উপরে। তার সারা গা কাঁপে ওঠে। এক অনতিক্রম্য ভয় যেন তাকে স্থবির করে তোলে। তার মনে হয় সাপের জিভের মতো রিভলভারের ঠাণ্ডা নল তার রগের কাছটা চেটে নিচ্ছে। আর ঠোঁটের উপরে দংশন করেছে বিষাক্ত কীট। তার ঠোট বুঝি কেটে যায় বিপুলের ধারালো দাঁতে। রক্তের নোনতা স্বাদ নীলা তার জিভে টের পায়।

     বিপুল তার কানের কাছে তেমনি ঠাণ্ডা হিস হিসে গলায় বলে,

     হানি, বুঝতে পারছ তো, আমি কী বলছি। একদম আমার কোনও বিষয়ে নাক গলাবে না। বুঝেছ? খাও দাও মস্তি করো যা ইচ্ছা করো। টাকা ওড়াও। কিন্তু ভুলেও আমার কোনও ব্যাপারে নাক গলাবে না বা কাউকে আমার বিষয়ে কোনও কথা বলবে না।

     এবার জোর গলায় বলে,

     বুঝেছ, আমি কী বলছি?

     নীলা বিস্ফারিত চোখে বিপুলের চোখের দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়ে। বিপুলের এমন চোখ সে কখনো দেখেনি। এমন মুখ সে কখনো দেখেনি। এই মুখের জন্যই কী সে পাগল হয়েছিল! এই মুখকেই কী সে পাগলের মতো ভালবেসেছিল? নীলার মনে হয়, বিপুল যেন এতকাল এক মুখোশ পরেছিল। আজ সেই মুখোশ খসে পড়েছে। সে কোনও ক্রমে বিপুলের হাতের ফাঁস ছাড়িয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। তার তখন খুব কাঁদতে ইচ্ছা করছিল। কোথাও মুখ গুঁজে চিৎকার করে সে কাঁদতে চাইছিল। শেষে আর কোনও একান্ত স্থান না পেয়ে রান্না ঘরে পালিয়ে গিয়েছিল। বেতের মোড়ায় বসে নরম কুশনকে বুকে চেপে ধরেছিল। 

     সেই থেকে ওই ঘর আর ওই বন্দুকের ভয় তাকে পেয়ে বসেছে। সে পারতপক্ষে ওই ঘরে যেতে চায় না। কিন্তু যেতে হয়। যেতে বাধ্য হয়। মাঝরাতে মদ্যপ বিপুল তাকে টেনে নিয়ে যায়। বিছানায় ফেলে নীলার নরম শরীরকে পিষতে থাকে। তবু নীলার শরীর আর জেগে ওঠে না। তার শরীর যেন অনন্ত এক ঘুমে নির্বাসিত হয়ে গিয়েছে। শুধু তার শরীরের ভিতরে যখন আর একটি শরীরের অতিরিক্ত এক মাংস-খণ্ড প্রবিষ্ট হয়, তখন অদম্য এক ঘৃণায় তার শরীর শিউরে ওঠে। বিপুল হয়ত সেটাতেই আনন্দ পায়। কিংবা পায় না। নীলা তার কোনও খোঁজ রাখে না।

     কতবার ভেবেছে, সে এই বন্দীদশা থেকে পালিয়ে যাবে। তখনো বাবা বেঁচে ছিল। মা বেঁচে ছিল। বাবার সামনে গিয়ে সে দাঁড়াতেই পারত। নীলা অনুনয় করে বলেছিল,

     বিপুল আমাকে এবার ছেড়ে দাও। তুমি তোমার মতো থাকো। আমি চলে যাই। কথা দিচ্ছি, আমি তোমার কোনও ক্ষতি করব না।

     কিন্তু, বিপুল তাকে হাসতে হাসতে বলে দিয়েছে,

     আমাকে ছেড়ে যাবার কথা স্বপ্নেও ভেবো না। তুমি আমার অনেক কিছুই জেনে গিয়েছ।তোমাকে এখন ছেড়ে দিই কী করে!

     বিপুলের হাতে খেলা করছিল সেই কালো বন্দুকটি।

     একটু থেমে বিপুল আবার বলেছিল,

     আর কোথায় পালাবে? আমার কাছ থেকে পালিয়ে গেলে, তোমার বাবা মা কাউকেই আমি ছাড়ব না।

     তারপরে বন্দুকটা নীলার দিকে তুলে ধরে বলে,

     তোমাকে তো আগেই বলেছি, এটা এমনিতে শান্ত, কিন্তু আমার হাতে থাকলে মাঝে মাঝে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে।

     নীলা কুঁকড়ে বসেছিল। সে কান্নাকাটি করেনি। তার কান্নার জল শুকিয়ে গিয়েছে। তার মালুম হয়েছে, ভালোবাসা যখন মরে যায় তখন তা মানুষের বুকের ভিতরটাকে পুড়িয়ে শূন্য করে দেয়। নীলা সেই পোড়া আর শূন্য মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে একা।

     কয়েকমাস আগে একটা অ্যাকসিডেন্টে বাবা চলে গেলেন। বিপুল সঙ্গে করে তাকে নিয়ে গিয়েছিল। শেষবার সে বাবাকে দেখল। কতো দুঃখ নিয়ে বাবা চলে গেল। তবু বাবার একটাই শান্তি বোধহয়। অপছন্দের জামাইয়ের মুখটা দেখতে হল না।

     বাবার শোকেই হয়ত মা চলে গেল মাস খানেকের মধ্যেই।

     নীলা এখন একা। সে চাইলেই কী মুক্তি নিতে পারে! নীলা ভাবে মাঝে মাঝে। কিন্তু আবার ভাবে, সে কোথায় যাবে? নিজের প্রতি এখন তার আর কোনও বিশ্বাস নেই।

     নীলা উঠে গিয়ে দেখল কেটলিতে জল প্রায় শুকিয়ে এসেছে। নিজের ভিতরে এতোটাই সে মগ্ন হয়ে ছিল যে খেয়াল করেনি কতো রাত হয়ে গিয়েছে। সে গ্যাসটা বন্ধ করে দিল। বিপুল অনেক রাত করে বাড়ি ফেরে বলে ডিনার করতে তাদের দেরি হয়। নীলা দেখল সেই সময়ও পেরিয়ে গিয়েছে। সে ভাবল, বিপুল কী তবে আজও ফিরবে না? নীলা রান্না ঘরের বড় আলোটা নিভিয়ে দিয়ে ডিম লাইটটা জ্বালল। মোড়ায় গুটিসুটি হয়ে নিজেকে এলিয়ে দিল। কোনও খিদে সে অনুভব করছে না। আজকাল তার এমনটা হয়। সন্ধ্যাবেলা ভাজাভুজি খাবার পরে রাত্রে তার আর তেমন খিদে পায় না। তবু বিপুলের সঙ্গে তাকে এক টেবিলে বসতে হয়। বিপুল খেতে থাকে আর নীলা উল্টোদিকের চেয়ারে বসে খাবার নিয়ে নাড়া চাড়া করে। স্যালাড থেকে দু একটা টুকরো মুখে ফেলে নাড়তে থাকে।

     আরও কতক্ষণ পরে, নীলার খেয়াল ছিল না, বোধহয় একটু তন্দ্রার মতো এসে গিয়েছিল, বাইরের দরজার ল্যাচ ঘোরানোর শব্দে তার তন্দ্রা কেটে যায়। বিপুল এলো। বিপুলের কাছে চাবি থাকে। 

     এবার সে বিপুলের শিস দেওয়া শুনতে পেলো। বিপুল শিষ দিয়ে একটা গানের কলি ভাঁজতে ভাঁজতে ঘরে ঢুকছে।

     বসার ঘর থেকে সে হাঁক দিল,

     হানি, কোথায় তুমি?

     নীলার মনে হল বিপুলের গলা খুশীতে ভরপুর হয়ে আছে। নীলা সাড়া দিল না। বিপুল জানে নীলা কোথায় থাকতে পারে। নীলা দরজায় তার স্বামীর লম্বা ছায়াটা দেখতে পেলো।

     বিপুল আবার খুশি খুশি গলায় বলল,

     হানি, তুমি এখানে কী করছ? অন্ধকারে বসে?

     বিপুল শব্দ করে সুইচ টিপে আলো জ্বালাল।

     হঠাৎ জোরালো আলোয় নীলার চোখ ধাঁদিয়ে গিয়েছিল। চোখ সয়ে যেতে সে লক্ষ করল, বিপুলের মুখে উপচে পড়া খুশি। সে তার ফ্যান্সি সবজে রঙের  ইমপোর্টেড সোয়েটারটা কাঁধে ফেলে রেখেছে। নীলা এই সোয়েটারটাকে একেবারে দেখতে পারে না। সোয়েটারের সামনের দিকে তিনটি বোতাম, কী বিশ্রী লাল রঙের!

     বিপুল সেই সোয়েটারটি নীলার গায়ের উপরে ছুঁড়ে দিয়ে নীলার হাত ধরে টেনে বলল,

     ঘরে এসো হানি! একটু ভালোবাসা করি।

     সে হা হা করে হেসে উঠল।

     সোয়েটারে কী বীভৎস মদের আর কটু তামাকের গন্ধ। নীলার গা গুলিয়ে ওঠে। নাক কুঁচকে ওঠে।

     নীলা নিজেকে সামলে নিয়ে আমতা আমতা করে বলে,

     বিপুল, আজ থাক না! অনেক রাত্রি হল।

     বিপুল আবার গলা ফাটিয়ে হেসে উঠল। সে টানতে টানতে নীলাকে শোবার ঘরে নিয়ে এসে বলল,

     রাত্রি? কোথায় রাত্রি? এখনো তো মাঝরাতই হয়নি।

     নীলা স্বামীর কথার পিঠে বলল,

     না, বিপুল। এখন প্রায় পৌনে দুটো বাজে।

     নীলা ইশারায় শোবার ঘরের দেওয়ালে ঝোলানো সুদৃশ্য ঘড়িটা দেখিয়ে দিল। বিপুলের গলায় এবার উষ্মা। সে বিরক্তির গলায় বলল,

     তুমি ভুল দেখছ। এখন বারোটাই বাজেনি। আমি বলছি এখনো বারোটা বাজেনি। সে ঘড়ির কাছে গিয়ে হাত বাড়িয়ে ঘড়িটা নামিয়ে আনল। তারপরে সেই ঘড়ির কাঁটা বন বন করে ঘুরিয়ে ঠিক পৌনে বারোটার কাছে নিয়ে এসে আবার ঘড়িটাকে দেওয়ালে ঝুলিয়ে দিল। এবার সে একটা হুঙ্কারের ভঙ্গিতে বলল,

     দেখতে পাচ্ছ তো এখনো বারোটা বাজেনি। আর হ্যাঁ। এই কথাটা সব সময়ে মনে রাখবে, তোমার স্বামী বারোটার অনেক আগেই বাড়ি ফিরে এসেছে। বুঝেছ!

     তার গলার স্বর নিষ্ঠুর পশুর মতো হয়ে গিয়েছে। সে পকেট থেকে বন্দুকটা বার করে নীলাকে দেখিয়ে দেখিয়ে সেটাকে ওয়ারড্রবে ঢুকিয়ে রাখল। তার কাঁধের ঝোলা ব্যাগ থেকে বেশ কিছু টাকা বার করে তার নির্দিষ্ট টাকা রাখার জায়গায় রাখল।

     নীলা চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে দেখছিল। সে ঠিক জানে না বিপুলের কাছে এতো টাকা কী ভাবে আসে!

     বিপুল জামা প্যান্ট খুলে সেগুলিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নীলাকে বিছানায় টেনে নিলো। নীলা অসহায়ের মতো নিজেকে বিপুলের হাতে সঁপে দেয়।

     বাকি রাতটা প্রায় জেগেই কাটল নীলার। রাত আর কতোটুকুই আর বাকি ছিল! ভোরের আলো ফুটতেই নীলা বিছানা ছেড়ে ছাদে উঠে গেল। রাতের নিদ্রাহীনতায় তার দুই চোখ কর করে, সেই সঙ্গে একটা ক্লান্তি আর অসহায়তা তার কাঁধে চেপে বসে। তার কাঁধ যেন ভেঙে নুয়ে পড়তে চাইছে। সে একটা বাহারি গাছের টবের পাশে বসে থাকল। সবুজের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে তার চোখ যেন কিছুটা আরাম খোঁজে। সকালের রোদের কাছ থেকে সে যেন নিজের ভিতরে শক্তি সঞ্চয় করে নেয়।

     বেশ কিছুক্ষণ সে বসে থাকল। খবরের কাগজ দিয়ে গিয়েছে। চা বানিয়ে নিয়ে সে তার রান্নাঘরের প্রিয় আরাম চেয়ারে বসল। চায়ে চুমুক দিতে দিতে সে কাগজের পাতা ওলটাচ্ছিল। পেপারে পড়ার তেমন কিছুই নেই। রান্না ঘরেই একটা ছোট টিভি রেখেছে সে। টিভির নিউজ খুলতেই দেখল, তার এলাকার একটা খবর দেখাচ্ছে। পাশের পাড়াতেই এক মাঝ বয়সী লোক খুন হয়েছে। খুব কাছ থেকেই লোকটিকে গুলি করে খুন করা হয়েছে। পুলিশ কোনও ক্লু খুঁজে পায়নি এখনো, শুধু মৃতের মুঠোয় পাওয়া গেছে লাল রঙের একটা বড় বোতাম। পুলিশের ধারনা সেটা কোনও সোয়েটার বা জ্যাকেটের। তাদের ধারণা খুনটা হয়েছে মাঝরাতের কিছু পরে। 

     নীলা স্থির চোখে খবরটা দেখছিল। তার চোখের জ্বালা যেন আরও বেড়ে যাচ্ছে। সে উঠে শোবার ঘরের দিকে গেল। বিপুল উঠে পড়েছে। সে এক মনে বিছানায় বসে তার রিভলভার পরিষ্কার করছে।

     নীলা ঘরে ঢুকে দাঁড়াতে বিপুল মুখ তুলে তাকাল। সে তার পাশে খুলে রাখা গত রাত্রের সোয়েটারটা নীলার গায়ে ছুঁড়ে দিল।

     হানি, আমার এই লাল সোয়েটারের একটা বোতাম কোথায় পড়ে গেছে। এটায় তোমার সেলাইয়ের বাক্স থেকে একটা বোতাম নিয়ে লাগিয়ে দাও।

     নীলা একটু অবাক হয়ে বলল,

     এটা সবুজ সোয়েটার বিপুল।

     বিপুল মাছি তাড়াবার মতো নীলার কথাটাকে উড়িয়ে দিয়ে বলল,

     ওই হল। আমার কাছে সবই সমান। আর আমি যা বলছি সেটা আগে করো। এখন যাও।

     নীলা তবু সেখান থেকে নড়ল না। সে স্থির চোখে বিপুলের দিকে তাকিয়ে বলল,

     বিপুল, তুমি এতো টাকা কোথা থেকে পাও?

     কোথা থেকে পাই মানে! তোমাকে তো আগেই বলেছি, বিজনেস করি। আর তোমার এর বেশী কিছু জানার নেই। এখন যাও। বোতামটা ঠিক করো। আমি দুপুরে বের হব।

     নীলা তবু সেখান থেকে সরল না। সে অনুনয়ের সঙ্গে বলল,

     বিপুল, তুমি আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দাও। আমি তোমার কোনও ক্ষতি করব না।

     তার কথা শুনে বিপুল হা হা করে হেসে উঠল। নীলা যেন খুব একটা হাসির কথা বলেছে। তার পরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

     আমি তো তোমাকে আগেই বলেছি। এটা হবে না। এখানে থাকো। মস্তি করো। যত ইচ্ছা টাকা খরচ করো।

     একটু থেমে সে আবার বলল,

     তুমি তো জানো, আমার কথার অবাধ্য হলে আমি কতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠি। তাই আবার বলছি আমার কথার অবাধ্য হবে না। এখন যাও।

     নীলা আবার তার রান্নাঘরে ফিরে আসে। তার সারা শরীরটা কাঁপছিল। রাগ দুঃখ অভিমান সব একাকার হয়ে গিয়েছে।

     তবু শান্ত হয়ে শূন্য দৃষ্টিতে সে বসে থাকল। বসে বসে সে আকাশ পাতাল ভাবছিল। তার কোলের উপরে বিপুলের সেই সবজে সোয়েটার যার কাঁধের কাছে হলুদ বর্ডার। নীলা চোখ নামিয়ে দেখল, তিনটি লাল বোতামের মধ্যে মাঝের বোতামটি ছিঁড়ে পড়ে গেছে কোথাও। সুতোটা দেখে তার মনে হল, কেউ যেন টেনে ছিঁড়ে নিয়েছে বোতামটি।

     নীলা তার সেলাইয়ের বাক্স থেকে একটা বোতাম বেছে নিলো। তারপরে ধীর স্থির হাতে সেই বোতামটি যথাস্থানে লাগিয়ে দিল।

     দুপুরে লাঞ্চ করেই বিপুল সেই সোয়েটারটা গায়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল।

     নীলা শূন্য দৃষ্টিতে বসে থাকল।

     বিপুলের কয়েটি জায়গায় যাওয়ার ছিল। সেই সব সেরে সন্ধ্যার পরে বাড়ি ফেরার রাস্তার পাশে একটি বারে ঢুকে পড়ল। বিপুল এখানে মাঝে মাঝেই আসে। বারের ওয়েটারদের সঙ্গে তার ভালো পরিচিতি হয়ে গিয়েছে। একজন ওয়েটার অর্ডার করা একটা লার্জ হুইস্কি দিতে এসে বলল,

     বিপুলদা শুনেছেন তো! কাল রাতে কাছেই একটা লাশ পড়েছে। কী বাজে ব্যাপার বলুন তো! 

     বিপুল হাসি মুখে বলল,

     হ্যাঁ, শুনেছি।

     বিপুলের বেশ নেশা হয়ে গিয়েছে। তখন খেয়াল করল তার উল্টো দিকের চেয়ারে এসে একজন বসেছে। লোকটিকে কোথায় যেন সে দেখেছে। কিন্তু এখন মনে করতে পারছে না!

     লোকটি বলল,

     আমার নাম, সোমনাথ বটব্যাল। ইনস্পেক্টর সোমনাথ বটব্যাল।

     বিপুল এক দৃষ্টিতে তার দিতে তাকিয়ে থাকল। সে দেখল সোমনাথ বটব্যাল এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইনস্পেক্টর বলল,

     বিপুলবাবু শুনেছেন তো, গতকাল একটা মার্ডার হয়ে গেছে। আমরা লাল বোতাম ওলা সোয়েটার পরা একজনকে খুঁজছি। একটা লাল বোতাম মিসিং।

     কথাটার পরে যেন একটা প্রশ্ন ছিল। বিপুল মিইয়ে যাওয়ার মতো হেসে বলল,

     সে খুঁজুন না। আমাকে বলছেন কেন? দেখুন না আমার সোয়েটারে সবকটা সবুজ বোতাম। দেখছেন তো, আর সবকটা বোতামই আছে। তাই না?

     বটব্যাল স্মিত মুখে তাকিয়ে থাকল। সে দেখতে পাচ্ছে দুটি ম্যাড়-ম্যাড়ে লাল বোতামের মাঝে একটি উজ্জ্বল সবুজ রঙের বোতাম।

     লাল বোতাম দুটো ঠিক সেই বোতামটার মতো, যেমনটা তারা মৃত মানুষটার মুঠির মধ্যে পেয়েছে। 

     বিপুলের যেন হঠাৎ গরম লাগছিল। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সে এবার বিরক্ত হয়ে নিজের সোয়েটারে বোতামগুলো দেখল। ঠিকই তো আছে। নীলা ছেঁড়া বোতামের জায়গায় ঠিক অনুরূপ একটা বোতাম লাগিয়ে দিয়েছে। সে রাগত স্বরে বলল,

     কী দেখছেন এমন করে? দেখতে পাচ্ছেন না, তিনটি সবুজ বোতাম?

     বটব্যাল খর চোখে তাকিয়ে বলল,

     তিনটি সবুজ বোতাম?

     বিপুল এবার বোতামের দিকে আঙুল দেখিয়ে যেন গর্জন করে উঠল,

     হ্যাঁ হ্যাঁ, এই দেখুন তিনটে সবুজ বোতাম।

     সোমনাথ বটব্যাল মিটি মিটি হেসে বলল,

     কালার ব্লাইন্ড। বর্ণান্ধ তাই না?

     বিপুল তেমনি ঘামতে ঘামতে রাগত স্বরে বলল,

     তাতে কী হয়েছে। আমার তো সব বোতাম গুলোই ঠিক আছে।

     বটব্যাল হাসছিল। মাঝের বোতামটি যেটি নীলা আজ সকালে লাগিয়ে দিয়েছে, সেটির  দিকে দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল,

     দুটো লাল বোতামের মাঝে একটা উজ্জ্বল সবুজ বোতাম কী ভাবে এলো!

     তারপরে পকেট থেকে একটি লাল বোতাম বার করে বিপুলের চোখের সামনে তুলে ধরে।

     বিপুল সেই বোতামটির দিকে বেকুবের মতো তাকিয়ে থাকে। সে খেয়াল করে তার দুই পাশে দু-জন উর্দি-ধারী পুলিশ এসে দাঁড়িয়েছে। তার কপাল দিয়ে দর দর করে ঘাম নেমে তার সারা মুখ ভিজিয়ে দিচ্ছে। সে বুঝতে পারছে না, সে কী বলবে ? তার নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়।    

--০--

(ঋণ: কার্ট হ্যামলিন)

 

সংশ্লিষ্ট পোস্ট

এখানে আসবে না কেউ
রঙ্গন রায়

এখানে আসবে না কেউ

চেক - হ্যালো টেস্টিং - শুনতে পাচ্ছেন? শুনুন – জানালা দিয়ে হাওয়া ঢুকে গেল। ক্যালেন্ডারটা উড়ছে। দেওয়ালে ঘষটানির একটা শব্দ। পুরোনো বছর উড়ছে। আমি ৩১শে ডিসেম্বরে এসেই থমকে গেছি। বাইরে নতুন বছর চলছে, আমি পুরোনো বছরে। কীরকম অদ্ভুত লাগে। কাকতালীয় ভাবে দেওয়াল ঘড়িটাও বন্ধ। ব্যাটারি শেষ।

গল্প৭ মে, ২০২৪
অবনী বাড়ি আছো
পার্থসারথী লাহিড়ী

অবনী বাড়ি আছো

“আধেকলীন হৃদয়ে দূরগামী ব্যথার মাঝে ঘুমিয় পড়ি আমি সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া ‘অবনী বাড়ি আছ?”

গল্প৭ মে, ২০২৪
সঙ্গে লেডিস আছে
সত্যম ভট্টাচার্য

সঙ্গে লেডিস আছে

খ্যাঁচ করে বাসটা ব্রেক চাপতেই লোকজন সব পেছন থেকে একবারে হুমড়ি খেয়ে গায়ে পড়লো তৃষানের গায়ে আর তাতেই ওর চটকাটা গেলো ভেঙে। মুখ দিয়ে দু একটা ব কারন্ত শব্দ বেরিয়ে এসেছিলো আর একটু হলেই কিন্তু ঠিক তখনই তৃষানের মনে পড়লো এসব কিচ্ছু বলা যাবে না আজ কারণ সঙ্গে লেডিস আছে।

গল্প৭ মে, ২০২৪